Friday, 7 December 2018
আমার গল্প
- জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত
১ম
পর্ব
<!--
@page { margin: 2cm }
P { margin-bottom: 0.21cm }
-->
হাসির
ছবি প্রদর্শনী
চায়ের
কাপ হাতে নিয়ে কাগজটায় চোখ
রাখতেই একটা বিজ্ঞাপনে চোখ
আটকে গেল প্রবুদ্ধর। ডিস্ট্রিক্ট
আর্ট গ্যালারিতে হাসির ছবি
প্রদর্শনী আজ দুপুর বারোটা
থেকে। এমনিতে ছবি দেখার পোকা
নয় সে। কিন্তু বিজ্ঞাপনটা
পড়ে মনে হল অনেকদিন প্রাণখুলে
হাসেনি। ছবি দেখে যদি একটু
হেসে নেওয়া যায় মন্দ কি ?
তাড়াতাড়ি
চা-টা শেষ করে
করবীকে বাজারের ব্যাগ আর টাকা
এগিয়ে দেবার জন্য ডাকল। বলল,
শুনছ আজ দুপুরে চলো
আর্ট গ্যালারিতে যাই। বেশি
রান্নাবান্নার দরকার নেই।
মাছের ঝোল আর ভাত। বিকেলে
ফেরার সময় না হয় চপ-টপ
কিছু কিনে আনা যাবে।
সকাল
সকাল এমন একটা বিদঘুটে আব্দার
শুনে মেজাজটা চড়ে গেল করবীর।
প্রবুদ্ধকে শুনিয়ে শুনিয়ে
ছেলেকে বলল, ওই
শোন তোর বাবা বোধহয় খেপেছে।
ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই দুপুরে
বেড়াবার ডাক ছেড়েছে। তাও
কোথায়, না আর্ট
গ্যালারিতে। উফ্ কী শখ !
যদি সিনেমা যাবার
কথা বলত, তাও একটা
কিছু বুঝতাম। না একেবারে আর্ট
দেখাবে !
প্রবুদ্ধ
কিছু বলার চান্সই পেল না।
করবীর কথার তোড়ে ভেসে গেল।
ছেলে আর মেয়ে তো বাবার এই উদ্ভট
প্রস্তাব শুনে পাশের ঘরে হেসেই
খুন।
ব্যাগ
আর টাকা দিতে এসে করবী আবার
বলে, হঠাৎ
আর্ট গ্যালারিতে নিয়ে যাবার
শখ হল কেন বলো দেখি ? ওটা
একটা ঘোরার জায়গা হল ? লোকে
ছুটির দিনে বউ-ছেলেমেয়ে
নিয়ে বিকেলে কি সন্ধ্যায়
বেড়াতে বেরোয় – বাজারে যায়,
মলে যায় বা পার্কেও
যায় অনেকে। তোমার তো ওসব বালাই
নেই। যা-ও বা
বহুদিন পর শখ গজালে, তা-ও
কোথায়, না ভর
দুপুরে আর্ট গ্যালারিতে।
ওখানে ভদ্দরলোকে যায় !
দেখেছি না আগে।
দুটো ঘর জুড়ে কয়েকটা মাথামুণ্ডু
লাল-নীল-হলুদ
ছবি। ওগুলোর সামনে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে কয়েকটা লোক এমন মুখ
করে দাঁড়িয়ে থাকে যেন সব বুঝে
ফেলেছে। আমার বাবা বলতেন,
কার যেন তুলি মোছার
কাপড়কেই দারুণ ছবি বলে
ক্রিটিকরা বাহবা দেওয়ায় উনি
ফাঁপড়ে পড়েছিলেন। শোনো,
ওসব ভূত মাথা থেকে
নামাও। বাজারে যাও। সবজি যা
পারো নিয়ে এসো, আর
দয়া করে চেনা দোকানদারের কাছ
থেকে পচা মাছটি উঠিয়ে এনো না।
প্রবুদ্ধ
হাত বাড়িয়ে ব্যাগ আর টাকা
নেয়। চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগে
বলে, গেলে কিন্তু
ভালো হত। অমনি হাতা-খুন্তি-সাঁড়াশির
কনসার্ট শুরু হল যেন। আওয়াজের
তীব্রতায় পাশের ঘর থেকে
মনি-সুবুরা দৌড়ে
চলে এল – কি হল মা ?
আরে
দ্যাখ না, রোববারটা
কোথায় সবাই মিলে বসে আরাম করে
খাওয়া-দাওয়া করব
– তোর বাবার বরোটার সময় আর্ট
দেখাতে নিয়ে যাবার ভূত মাথায়
চেপেছে। রোজ সকাল-সকাল
রান্না হয়। আজ একটা দিনও কি
নিস্তার নেই ? বাইরে
বাইরে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াও
তো বোঝ না। মেয়েদেরও একদিন
রেস্ট চাই। উঠল বাই তো কটক
যাই। মাছ-ভাত
খেয়েই উনি বেড়িয়ে পড়বেন।
যতসব আদিখ্যেতা। মনির আর্টের
স্কুল আছে, সুবুর
সামনে পরীক্ষা। দিদির বাড়ি
কতদিন যাই না। ভাবলাম তোর
বাবাকে নিয়ে আজ একটু ঘুরে আসব।
কতদিন ওদের দেখি না।
- মা, আমার আর্টের ক্লাস থেকে ফিরতেই তো দেড়টা বাজবে। তোমরা বারোটায় গেলে কী করে হবে ? তাছাড়া বাবা বলেছিল বিকেলে বিশালে নিয়ে যাবে।
মনিকে
বাধা দিয়ে সুবু বলে,-- না
বিগ বাজারে যাব। স্টার ওয়্যার
আলটিমেটের সি.ডিটা
ওখানে আছে শুনেছি। আর ফেরার
সময় চিকেন-চিজ
প্যাটিস খেয়ে আসব। যা টেস্টি
না। বোন তুই একবার খাস। গত
মাসে তো শুধু পচা রঙের গোল্লা
খেয়েই কাটালি।
- তুই চুপ কর তো। ওটা চিকেন না গরুর মাংস তুই জানিস? আর প্যাটিস তো … ওয়াক্ থুঃ। শক্ত শক্ত। ওটা একটা খাবার হল ? বিশালে মনজিন্সের কর্ণার খুলেছে। বাবা ওখানে কেক খাওয়াবে বলেছে। তাই না বাবা ?
– বিগ
বাজারেও তো ফিফটিন্থে সুগার
অ্যান্ড স্পাইস্ কর্ণার
খোলার কথা ছিল। দেখি বাবা,
পেপারটা দাও তো।
ওপেনিঙের নিউজটা দিল কি না
দেখি।
প্রবুদ্ধর
বিশেষ কোনো উৎসাহ
ছিল না মনজিন্স বা সুগার অ্যান্ড
স্পাইসের কেক-এ।
সুবু কাগজটা তার হাত থেকে ছোঁ
মেরে নিতেই সে চেঁচিয়ে ওঠে –
এই, ছিঁড়ে
ফেলিস না দেখিস। ওতে দরকারি
কথা আছে।
মনি
জিজ্ঞেস করে – কী দরকারি কথা,
বাবা ?
– ও
তোরা বুঝবি না।
করবী
ততক্ষণে চায়ের টেবিল ছেড়ে
ফ্রিজ থেকে সবজির বাস্কেট
নিয়ে রান্নাঘরে সরে গেছে।
ছেলে-মেয়ে আর
বাবার যুগলবন্দী কানে গেলেও
আমল দিল না। সুবু-মনি
কিন্তু বাবাকে চেপে ধরল। –
বলো না বাবা, কী
দরকারি কথা আছে। কোন পেজ-এ
আছে ?
– তোরা
বুঝবি না, বললাম
না। ওসব বড়দের কথা। প্রবুদ্ধও
টেবিল ছাড়ে। তারপর হাল্কা
ভাবে বলে,– একটা
হাসির ছবির কথা। ছোট্ট করে
কথাটা বলেই সে গলা তোলে, –
আমি বাজারে গেলাম।
শেষ
কথাটা যে করবীকে উদ্দেশ্য
করে বলা তা সুবু-মনি
বোঝে, করবীও।
সুতরাং রান্নাঘর থেকে তার
গলা শোনা গেল – ক’টা
মাঝারি সাইজের চিংড়ি পেলে
নিয়ে এসো। চিঁড়ের পোলাও
বানিয়ে দিদির বাড়ি নিয়ে
যাব। ওরা খুব খুশি হবে।
প্রবুদ্ধর
কানে যায় কথাটা। মুখে কিছু
না বললেও জামাটা গায়ে গলাতে
গলাতে সে নিজের মনেই গেয়ে
ওঠে – তোমারো পরাণো যাহা
চায়, তাই
হোক, তা-ই
হোক গো.......।
তার দীর্ঘ নিশ্বাসটা রান্নাঘর
পর্যন্ত পৌঁছয় না। এবার সে
কামদা অ্যাপার্টমেন্টের
বি ব্লকের ফ্ল্যাট নাম্বার
থ্রি জিরো ওয়ানের করবাবু
ওরফে ‘কামদা’র
পেবোদা হয়ে বাজারে বেরোয়।
বন্ধ দরজার ওপারে রয়ে যায়
মনি-সুবু-করবীর
ঝাঁপতাল সহযোগে আনন্দরাগিণী।
২য়
পর্ব
ঘড়িতে
তখন ঠিক সাড়ে তিনটে। ইডেনে
নাইটদের খেলাটা শুরু হবো-হবো।
করবী শাড়ির আঁচল ঠিক করতে
করতে টি.ভি-র
ঘরে এল – কই গো, এখনও
খেলা দেখছ যে। জামা-কাপড়
পরো। আমরা তো রেডি। অ্যাই
সুবু, বসে আছিস
যে। যাবি না মাসির বাড়ি ?
ওঠ্।
সুবু
বলে, – দাঁড়াও
না। খেলা শুরু হবে এখ্খুনি।
তোমরা যাও, আমি
পরে যাব।
করবীর
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল,
– পরে
যাবি মানে ! একা
একা কীভাবে যাবি অতদূর ?
তোকে
আমি একা ফেলে যাবই না। তাহলে
ফিরেও দেখব টি.ভির
সামনে পড়ে আছিস। পড়বি না
তো এক ফোঁটাও। যদি পড়তিস,
তাহলে
বুঝতাম। চল্ চল্। মাসির বাড়ি
গিয়ে টি.ভি
দেখিস।
অগত্যা
রাগতভাবেই সুবুকে বিছানা
ছেড়ে উঠতে হল। প্রবুদ্ধও
জানত সুবুর রেজিস্টেন্সটা
দুর্বল। করবী-ঝড়ে
ছিটকে গিয়ে ওয়াড্রোবের সামনে
পড়বে। তারপর একটানে পুরনো
রঙ চটা নীল জিনস্ আর লাল-সাদা
ডোরা কাটা টি-শার্টটা
বার করে আনবে, দড়াম
করে ওয়াড্রোবের দরজাটা বন্ধ
করবে – উপহার হিসাবে পাবে
মায়ের চোখ রাঙানি, কিন্তু
দেখেও দেখবে না। এরপর পায়ে
চটি গলিয়ে সোজা চলে যাবে
ফ্ল্যাটের বেসমেন্টে। সবই
হল। এবার তার পালা। অন্যদিন
হলে এই উপলক্ষে একটা প্রশংসাবাক্য
শোনা যেত স্ত্রীর মুখে। কিন্তু
একে দিদির বাড়ি যাওয়ার আনন্দ,
তায় দুপুরে রসনার
পরিপূর্ণ তৃপ্তি। তাই বোধহয়
একটু মলয় বাতাস বয়ে গেল – যাও,
আজকে সাদা
পায়জামা-পাঞ্জাবিটা
পরে নাও। খেলা পরে এসে দেখে
নিও।
জ্যাম
ঠেলে সুবুদের মাসির বাড়ি
অটোতে আধ ঘন্টা। বাসে খরচা
একটু কম হলেও আজ দিদিকে সপরিবারে
সারপ্রাইজ দেবার জন্য ঢাউস
টিফিন ক্যারিয়ার সঙ্গে আছে।
লিফটে নামবার সময় মনি ওটা নিয়ে
প্রায় কাত হয়ে গেছে। প্রবুদ্ধ
অটোতে বসে করবীকে জিজ্ঞেস
করল, – কী কী নিলে
?
– কোথায়
আর নিতে পারলাম। একটা বড়
হটকেস কিনলে ভালো হত,
জানো।
কী অসুবিধে করে যে এ-ক’টা
নিয়ে এলাম। ঢাকনাটা ভালো করে
আটকায় না। বাটিগুলো ছোট ছোট।
ভাজাগুলো আঁটেই না। একবার
বিগ বাজারে বড় হটকেস দেখেছিলাম।
ওরকমটা হলে ভালো হত।
মনি
বাবার অবস্থাটা বোঝে,
– মা,
তুমি না যেন
কি ! বাবা
জানতে চাইল,
কী কী নিয়েছ।
করবীর
হুঁস ফেরে – বলছি তো দাঁড়া
না। বেশি কথা। … তারপর প্রবুদ্ধর
দিকে তাকিয়ে বলে,
– কী নিলাম?
এই তো,
দু-বাটি
ফ্রায়েড রাইস। বাসমতীটা আনলে
তো, ভাবলাম
এনেছো যখন এটা দিয়েই করে ফেলি।
পুরো প্যাকেটটাই রেঁধে ফেলেছি
চিংড়ি বাদাম-টাদাম
দিয়ে। একটু রেখে এসেছি – রাতে
টেস্ট কোরো। আর কয়েকটা ইলিশ
মাছ ভাজা,
দিদিরা কাল ঝোল
রেঁধে খেতে পারবে। আর তো মাত্র
একটা বাটি। ওটাতে মাংস এনেছি।
মিমিটা খুব ভালোবাসে। ব্যাস,
এই তো।
মনি
ওধার থেকে ফোড়ন কাটে – বাবা,
মা কিন্তু মাংসের
ঝোল আনেনি,
আলুও নয়। আর
বাড়িতে ইলিশ-চিংড়ির
স্টক ফিনিস।
এর
সঙ্গে যোগ হয় সুবুর টিপ্পনি
– মা আমাদের ফিমেল কর্ণ।
ফলে
করবী রেগে গেল। রাগাটা স্বভাবিক।
বাকি বাড়ির লোকগুলো কি না
খেয়ে রয়েছে। সবসময় নজর এত
নিচু কেন। জামাইবাবু দূরে
থাকেন। সবদিন তো দিদি আর মিমি
ভালো-মন্দ
খাচ্ছে না। একটু না-হয়
দেওয়াই হল। বাড়িতে তো প্রায়ই
এটা ওটা খাওয়া হয়। তখন কি ওরা
খেতে আসে না হাত বাড়িয়ে চাইতে
আসে।
কিন্তু
রাগটা বেড়ে চলার বদলে থেমে
গেল। কারণ অটোটাও দিদির বাড়ির
সামনে থেমে গেছে। ভাড়া চুকিয়ে
দোতলায় ওঠার মুখে প্রবুদ্ধ
জিজ্ঞেস করল,
– ফোন করে দিয়েছিলে
তো ?
– ফোন
করব কেন। এমনি দিদির বাড়ি
আসা যায় না!
তাছাড়া
ওরা জামাইবাবু এলেই কোথাও
বেরোয়। দু-দিন
বাড়িতে থাকে – হয় সিনেমা নয়
অন্য কোথাও নিয়ে যায়,
মল-টলেও
ঘুরে আসে। ওরা বেশ ভালোই আছে।
ঘুরুক,
সব
তো আর আমার মতো কপাল না।
এর
মধ্যে ছেলে-মেয়ে
দুটো ওপরে উঠে গিয়েছিল। ওরাই
সিঁড়ির মুখ থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে
খবরটা দিল,
– মা,
তালা।
– কী
বলছিস !
ভালো
করে দেখেছিস তো। কড়া নেড়ে
দ্যাখ।
বলতে
বলতে করবী ওপরে উঠে গেল।
প্রবুদ্ধর বুকে একটু আশার
আলো খেলে গেল। স্ত্রীর পেছনে
সে-ও
দোতলায় উঠে দরজার মুখে দাঁড়াল।
সত্যিই একটা বড় গোদরেজ তালা
ঝুলছে। কোথায় গেল ওরা ?
করবী
সুবু-মনিকে
বকতে শুরু করে দিল,
– তোদের জন্য।
সেই সকাল থেকে আসব না আসব না
করছিলি।
প্রবুদ্ধকে
বাধা দিতে হয় – এখন চুপ করো
তো। চলো,
আরেকদিন আসা
যাবে।
–
দাঁড়াও,
এগুলো কী করব
?
– নিয়ে
চলো। কোথায় আর বসবে। কোথায়
গেছে, কখন
ফিরবে, কিছুই
তো জানো না।
সুবুরাও
সায় দিল টিফিন ক্যারিয়ারটা
ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। রাতের
খাওয়াটা বেশ জমবে তাহলে।
করবী,
দাঁড়াও
তো, বলে
পাশের ফ্ল্যাটের ডোরবেল
টিপল। মিনিট দুয়েক পর এক ভদ্র
মহিলা দরজা খুলে বাইরে উঁকি
মারলেন । প্রথমটা ঠিক বুঝলেন
না আগন্তুকরা কারা। তারপরই,
– ওমা
করবী যে !
কতদিন
পরে দেখলাম !
আজকাল
কম আসো দিদির বাড়ি। তা তোমার
দিদি তো এই একটু আগে বেরোল।
আমার বউমাও সঙ্গে গেছে।
চারতলায় রায়বাবুর ছেলের কাল
অন্নপ্রাশন। ওই একটু গিফট্
কিনবে আর মিমিদের কোন বান্ধবীর
বাড়ি যাবে। আমার নাতনিটাও
একসঙ্গে পড়ে কি না। তা তোমরা
কি একটু বসবে ?
মনি
তো একদম রাজি নয়,
সুবু আগেই নীচে
নেমে গেছে। ভদ্রমহিলার কথা
শুনে প্রবুদ্ধর মনে হল তিনি
চলে যেতেই বলছেন। কারণ এতগুলো
কথা তিনি দরজা অল্প ফাঁক করে
শরীরটা বাইরে বার করেই বলছিলেন।
বাঁচাল করবীই। সে বলল,
– না মাসিমা,
বসি না আর। আমার
ছেলেটারও এক বন্ধুর বাড়ি
যেতে হবে নোটস্ আনতে। আপনি
কষ্ট করে এটা একটু রাখবেন ?
– টিফিন ক্যারিয়ারটা
তুলে ধরল ভদ্রমহিলার সামনে।
– দিদিকে বলবেন,
মিমি আপনার
নাতনি আর এ-বাড়ির
বউদিকে নিয়েই যেন খায়। একটু
ফ্রায়েড রাইস আর মাংস আছে।
ভদ্রমহিলা
খুশি হলেন মনে হল কিন্তু সেটা
প্রকাশ করলেন না,
– ঠিক আছে দাও।
ওরা এলে দিয়ে দেব। উনি দরজার
ভেতর অদৃশ্য হতেই করবীরা
নীচে নেমে এল।
এবার
কী করা ?
সুবু
ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করল
– শুধু শুধু আই পি এল ম্যাচটা
দেখা হল না। নাইটের ইমপরট্যান্ট
খেলা ছিল। ফোন-টোন
না করে চলে এলাম মাসির বাড়ি
!
মনিরও
আব্দার শুরু হল বিশালে যাবার।
শুনে সুবুও চাইল বিগ বাজারে
যেতে। করবী কিছু না বলে
হাঁটছে। মোড় অব্দি না গেলে
ফেরার বাস বা অটো পাওয়া যাবে
না। মিশন আনসাকসেসফুল। তাই
ওর মুখ ব্যাজার। এই পরিস্থিতিতে
আর্ট গ্যালারির কথা একবার
মনে উঁকি দিয়ে গেলেও প্রবুদ্ধ
কিছু বলল না। হাঁটতে হাঁটতে
একবার জিজ্ঞেস করল করবীকে,
– সুবুর কোন
বন্ধুর বাড়ির যাবার কথা
বলছিলে যে,
যাবে নাকি ?
– কোথায়
বললাম ?
প্রবুদ্ধ
ধরিয়ে দিল,
– ওই যে ভদ্রমহিলাকে
বললে না ?
– ওটা
কথার কথা। নাহলে মাসিমা হয়ত
বলতেন বাড়ি নিয়ে যাও। তাছাড়া
দিদিকে বলতে পারবেন যে আমরা
অন্য কোথাও গেছি,
দিদিও শুনে আর
মন খারাপ করবে না। পরে দিদিকে
বুঝিয়ে বলা যাবে।
– তাহলে
এখন কোথায় যাবে,
বাড়ি ?
সুবু-মনিরা
বাড়ি ফিরতে রাজি নয়। ওদের
শান্ত করতে শেষ পর্যন্ত
বিশালে যাওয়াই ঠিক হল। বিগ
বাজার আরেকদিন হবে। বাসে
বাসে অত ঘোরা সম্ভব নয়। ওদের
কাছে এটা নেই মামার চেয়ে কানা
মামা লাভের মতো। অতএব মেনে
নিল। এদের মুখে হাসি ফুটে
উঠতে দেখে ভালোই লাগল।
প্রবুদ্ধর মনে হল,
ছোটদেরই
মজা। তাদের উটকো বায়নাক্কাগুলোও
বেশ মিটে যায়।
বিশালে
বেশি সময় লাগল না। বাসটা
তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়ায়
মলটাকে প্রায় ফাঁকাই পাওয়া
গেল। মনির কেক খাওয়া আর সুবুর
সি.ডি
কেনা – দুই-ই
হল। ভাগ্য ভালো স্টার ওয়ারের
সি.ডিটা
পাওয়া গেল। নইলে আবার একদিন
বিগ বাজারে যেতে হত। করবীরও
মন মেজাজ খারাপ। বিশেষ কোনো
কথা বলছে না। মল থেকে বেরোতে
পারলেই যেন বাঁচে। অতএব
বিশাল থেকে যখন বেরিয়ে এল
ওরা তখনও বিকেলের ভাবটা
রয়েছে।
অগোছালো ভাবে
চারজন চলেছে বাসস্ট্যান্ডের
দিকে। বাড়ি ফিরতে হবে। করবী
তখনও চুপচাপ। প্রবুদ্ধ তাকে
বোঝায়, –
কী করবে মন খারাপ
করে। সামনের রোববার না হয়
ফোন করে সকালবেলাতেই ওদের
বাড়ি যাওয়া যাবে।
করবী
কোনো জবাব দেয় না। প্রবুদ্ধ
আশায় বুক বেঁধে বলেই ফেলে,
– যাবে নাকি
একবার আর্ট গ্যালারিতে ?
এই তো সামনেই।
পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যাব।
করবী
‘না’
বলতেই যাচ্ছিল,
কিন্তু
মনি আর সুবু প্রস্তাবটা লুফে
নিল। অবশ্য প্রদর্শনী দেখার
জন্য নয় – সামনের পার্কে বসার
জন্য। করবী সায় দিল,
– তাহলে
তুমি দেখে এসো,
আমরা
বাইরে পার্কে বসে থাকব।
কতক্ষণ লাগবে তোমার ?
প্রবুদ্ধ
এই প্রস্তাবে রাজি হল না।
বলল, – গেলে
একসঙ্গেই যাব। তোরাও মজা
পাবি, হাসির
ছবি তো।
– হাসির
ছবি ? সেটা
আবার কেমন ?
– চল্
না। গেলেই তো দেখবি। আমি তো
আর দেখিনি,
কাগজে বিজ্ঞাপন
দেখলাম সকালে,
তাই বললাম।
করবী
জিজ্ঞেস করল,
– হাসির ছবি
প্রদর্শনী হয় নাকি ?
হাসির ছবি মানে
তো কার্টুন। কার্টুন এক্সিবিশন্
বলো তাহলে।
– মিকি
মাউস না আর.
কে ?
সুবু জিজ্ঞেস
করে।
– কার
কার্টুন বা ছবি তাতো জানি
না। বিজ্ঞাপনে দেখলাম। তাই
বলেছি। এখন তোরা গেলে চল,
না গেলে বাড়ি
যাবার বাস ধরি।
এ-কথায়
কাজ হল। সবাই মিলে বাসে উঠল।
সন্ধের আগেই পৌঁছে গেল
গ্যালারিতে।
৩য়
পর্ব
বড়
হলঘরের তিনদিকের দেওয়াল জুড়ে
সারি সারি মাউন্ট করা ছবি।
প্রত্যেকটার নীচে একটা করে
নাম দেওয়া আছে। ছোট ছোট আলোগুলো
এমন ভাবে সাজানো যে আঁকা
ছবিগুলোকে মনে হচ্ছে জীবন্ত।
কোনোটা জল রঙের,
কোনোটা তেল রঙের
আবার কোনোটা শুধু পেন্সিলের
স্কেচ। নানা রকমের মুখ বা
মুখের আদল। ছবিগুলোর মাঝে
মাঝে দেওয়ালে আবার মজার আয়না
লাগানো। মনিরা সবাই আয়নায়
নিজেদের চেহারা আর অদ্ভুতদর্শন
ছবিগুলো দেখে খুব হাসছে।
করবীও। প্রবুদ্ধও দেখছে
ছবিগুলো। সবগুলোতেই হাসির
ব্যাপার আছে বলে তার মনে হচ্ছে
না। কয়েকটা তো মনে হচ্ছে আগে
কোনো ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিনে
দেখা। ঘুরতে ঘুরতে একটা ছবির
সামনে প্রবুদ্ধকে দাঁড়িয়ে
পড়তে হল।
আরে
ছবিটার নীচে ‘পেবোদা’
লেখা আছে !
– প্রবুদ্ধ
আশ্চর্য হয়। তার নামে ছবি !
দেহটা
বড় মাথাটা ছোট ছবির লোকটার।
একখানা জ্বলন্ত উনুনের উপর
বসে হাসছে। মাথাটা প্রবুদ্ধর
কেমন ঘুলিয়ে গেল। একটা হাত
এসে তার সঙ্গে করমর্দন করল।
সে চোখ তুলে দেখল,
ছবির
লোকটা !
চারদিকে
তাকিয়ে দেখল প্রবুদ্ধ – কিছু
ভুল হচ্ছে না তো ?
করবীরা
একটু দূরে কার্টুন দেখে হাসছে।
সব ঠিকই তো আছে। ছবির
লোকটা ততক্ষণে হাত ছেড়ে দিয়ে
খুব হাসছে। – কি,
কেমন
লাগছে এক্সিবিশন ?
অনেকদিন
তো প্রাণখুলে হাসোনি। এবার
হাসি পাচ্ছে তো ?
আমতা
আমতা করে প্রবুদ্ধ ওর সঙ্গে
কথা বলতে শুরু করে – কিন্তু
নিজের কার্টুন দেখে কার হাসি
পাবে!
– নিজের
ছবি !
কোথায়
? এটা
তো আমার ছবি। অবশ্য এ-ছবি
যদি কেউ নিজের বলে ভাবে তাতে
আপত্তি নেই। আর নিজের ছবি
দেখে হাসতে পারলে এর মতো মজা
আর কোথাও পাবে না। বুঝেছ।
মজাটি শুধু চারদিক দেখেশুনে
খুঁজে বার করে নেওয়া। ব্যাস্।
কেল্লাফতে।
– কীভাবে
মজাটা খুঁজব?
– প্রশ্নটা
প্রবুদ্ধ যেন নিজেকেই করে।
তবে
উত্তরটা আসে ছবির ভেতর থেকে,
– নিজের খুঁতটা
খুঁজে নাও। ভাবো সেটা তোমার
ভেতরের পেবোর খুঁত। এই পেবোটা
কিন্তু অন্য লোক – এই যেমন
আমাকে দেখছ। আমি তুমি নই আবার
একরকম তুমিও। আমার ছবি দেখে
তুমি থমকে দাঁড়াচ্ছ আবার
হাসছ। একটু পরে তোমার বউ
ছেলে-মেয়েও
হাসবে। দুনিয়া অন্যের খুঁত
দেখেই হাসে,
মজা পায়। তুমিও
পেবোকে অন্য মানুষ হিসাবে
দেখ, জীবনে
আসল মজা পাবে। এর জন্য প্র্যাকটিস
দরকার।
শেষের
কথাটা কানে দুবার বাজল।
প্রবুদ্ধ দেখল ছবির পেবোদা
তেমনি দাঁত বার করে উনুনের
ওপর বসে আছে। পাশ থেকে করবী
সুবু-মনিকে
বোঝাচ্ছে এরকম কার্টুন আঁকতে
বহু প্র্যাকটিস দরকার। ওরা
যে চলে এসেছে খেয়াল হয়নি
প্রবুদ্ধর। সে করবীকে জিজ্ঞেস
করে, – বাড়ি
যাবে না ?
– দাঁড়াও
অনেকদিন এভাবে হাসিনি। আরেকটু
থাকি।
ছবির
নামটা নজরে আসতেই মনি চেঁচিয়ে
ওঠে – দাদা দ্যাখ,
বাবার
নামে কার্টুন। করবী-সুবু
‘পেবোদা’
লেখা কার্টুনটা দেখে
হাসতে হাসতে প্রায় লুটিয়েই
পড়ে আর কি !
প্রবুদ্ধ হেসে
ফেলে, বলে
– এটা আমার নয়। তার মুখের
অবস্থা দেখে মনিরা আরও জোরে
হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই আর্ট
গ্যালারি থেকে ওরা বেরিয়ে
আসে।
বাসে
ওঠার আগে প্রবুদ্ধ বলে,
বাড়ি চলো। আজ
সারাদিনে কতবার ওরকম কার্টুন
হলাম দেখাব। ছবি এঁকে রাখিস
তোরা।
--------------------------
Subscribe to:
Posts (Atom)