Wednesday, 6 July 2011

শহুরে বাঘ

ফ্লাইওভারের নীচে রাস্তাটা ঘুরতেই চোখে পড়ল ধোনিকে। হ্যাঁ, সমুর দেখতে ভুল হয়নি। যদিও কয়েক সেকেন্ডই দেখা গেল চলতি গাড়ি থেকে, তবু তার চোখ ঠিকই দেখেছে। ধোনি, বাহাদুর ক্রিকেট অধিনায়ক বলছেন বাঘ বাঁচাও, ভারত বাঁচাও। এরকম আরও কয়েকটি বিজ্ঞাপনের পোস্টার অনেক জায়গাতেই লাগানো আছে। উদ্দেশ্য শহরের মানুষকে সচেতন করা। সমু ভাবে, সত্যিই তো – চল্লিশ হাজার থেকে যদি সংখ্যাটা মাত্র হাজার দেড়েকে এসে দাঁড়ায়, ব্যাপারটা বেশ চিন্তার। অন্তত পরিবেশবিদদের কাছে। কাল যখন নেহেরু পার্কে টাইগার পয়েন্টটা উদ্বোধন করতে গিয়ে মি. পারিখ কথাগুলো বলছিলেন তখন মনে হচ্ছিল সামনে সত্যিই ভীষণ বিপদ। জাভা, বালি ইত্যাদি দ্বীপগুলোতে বাঘ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেই কবেই। সুমাত্রা, সাইবেরিয়াতেও তারা হারিয়ে যাবার মুখে। যা আছে তা ভারতে আর চিনে। এখন এদের যদি বাঁচানো না যায় তবে পৃথিবীর চেহারাটাই নাকি বদলে যাবে। সমুর মনে পড়ে গিয়েছিল স্কুলের পড়ার কথা – বাঘ না থাকলে তৃণজীবীদের বাড়-বাড়ন্ত হবে, তারা সব ঘাস খেয়ে ফেললে মানুষ বাঁচবে না। তাই বুঝি বিশ্ব জুড়ে চলছে বাঘ বাঁচানোর বিশাল যজ্ঞ। চিড়িয়াখানার কর্তা থেকে শুরু করে অনেক হোমরা-চোমড়ারাই ছিলেন কালকের মিটিং-এ। কত সব কথা। পার্কের মধ্যে যাঁরা বাচ্চাদের নিয়ে বা পুরো ফ্যামিলিসহ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তাঁরাও মিটিং শুরুর পর একে একে এসে জড়ো হয়েছিলেন শামিয়ানা খাটানো মঞ্চের সামনে। পড়ন্ত বিকেলের পার্কে কয়েক জোড়া সদ্য বিবাহিত বা অবিবাহিত যুবক-যুবতীও ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছিলেন এদিক ওদিকে। গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে সমুও ছিল তাদের মধ্যে। পটাপট কয়েকটা স্ন্যাপ আর তিন কলামের মতো রিপোর্ট খবরের অফিসে জমা দিলেই সেদিনের মতো তার ডিউটি শেষ। বাঘ বাঁচল কি মরল তাতে তার কিছু যায় আসে না। সম্পাদক-বাঘের হাত থেকে বাঁচতে পারলেই যথেষ্ট। অতএব মঞ্চে যে যা বলছেন তার একটা নোট নিতে সে সবুজ ঘাসের ওপর বসে পড়েছিল। কাছেই একটা দোলনা আর তাকে ঘিরে বাচ্চা ও মায়েদের জটলা। সমু শুনল একটা বাচ্চা তার মা-কে প্রশ্ন করে করে বিরক্ত করছে ‘ওমা, মা, ওই আঙ্কলটা কী বলছে মা? ব্যাগ্র কী মা?’ মা-টি তাকে বোঝালেন, ‘আঙ্কলটা টাইগারের কথা বলছে, তুমি দেখেছো না জাঙ্গল বুকসে শের খানকে।’ ‘শের খান কী করেছে? আঙ্কলরা কি শের খানকে বকছে? শের খান কি এখানে আসবে? শের খানকে কি ওরা মেরে ফেলবে?’ ইত্যাদি নানা প্রশ্নে সে তার মা-কে বিব্রত করে তুলছিল। ভদ্রমহিলা শেষ পর্যন্ত তাকে বকে থামিয়ে দিলেন, ‘চুপ করো তো। নইলে ওই যে টাইগার দুটো আছে, এসে কামড়ে দেবে, তখন বুঝবে।’ সমু তাকিয়ে ছিল ভদ্রমহিলার দিকে। ওর কথা শুনে শামিয়ানা ঘেরা জায়গার দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখল সত্যি দুটো বাঘ দু-পাশে দাঁড়ানো। দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই আসল না নকল। মনে হচ্ছিল, এখখুনি হালুম করে যদি লাফিয়ে পড়ে....। পড়তেই পারে। কম্পুটার আর ইলেকট্রনিক্সের দৌলতে পুতুলকে দিয়ে তো কত কিছুই করানো হচ্ছে। মি. পারিখ বলে যাচ্ছিলেন, ও-দুটো এখন থেকে নেহেরু পার্কেই থাকবে। বাচ্চাদের মনোরঞ্জন যেমন করতে পারবে তেমনি বাঘেদের জীবন সংরক্ষণে সাধারণ লোকেদের সচেতনতাও বাড়াতে পারবে।’ সমু ভাবছিল,ভাগ্যিস এটা পুতুল। তাই পার্কে থাকলে বিশেষ কোনও অসুবিধে হবে না। নাহলে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ানো দূরে থাকুক, প্রাণভয়ে সবাই পার্ক ছেড়ে পালাত। রিপোর্টে সে পারিখের এই পরিকল্পনার কথা ফলাও করে লিখল বটে, কিন্তু এতে সচেতনতা কতটা বাড়বে সেটা নিয়ে তার একটা ধন্দ রয়ে গিয়েছিল। তবে আমোদ যে পুরো মাত্রায় হবে সে-বিষয়ে সমুর মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। তাই ছোট্ট করে নেহেরু পার্কে এন্ট্রি ফি বাড়ার কথাটাও পাঠককে জানিয়ে দিয়েছিল, আজকের কাগজে সে রিপোর্ট বেরিয়েও গেছে। অনুষ্ঠানের শেষে সমু অন্যান্য সাংবাদিকদের সঙ্গে পারিখকে বাইট দেবার জন্য চেপে ধরেছিল। পারিখ হাসি হাসি মুখ করে যা বলেছিল তার মোদ্দা কথাটা হল, পার্কে কয়েকদিনের মধ্যেই আরও কয়েকটা বাঘ এসে যাবে। তারা বাচ্চাদের সঙ্গে হাত মেলাবে, চকলেট দেবে। টকিং টাইগাররা ওদের সঙ্গে কথা বলবে। সমু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘টকিং টাইগাররা কি একেবারে হালুম করবে?’ পারিখ বলল,-- ‘না না একেবারে সিম্পল অ্যামিউজমেন্ট। কম্পুটারে ডাটা ফিট করা থাকবে, বাচ্চারা বাঘের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেই সেই সেগুলো শুনতে পারবে। ইচ্ছে করলে বড়রাও হাত মেলাতে পারেন, যাতে বাচ্চারা ভয় না পায়।’ তারপর একটু চোখ টিপে বলেছিলেন, ‘দেখুন না আরও কত অ্যামিউজমেন্টের ব্যবস্থা করি। আমাদের কোম্পানির এই টাইগার প্রোজেক্ট একটা দারুণ ব্যাপার। দেখে চমকে যাবেন, অনেক সারপ্রাইজ আছে। আপনারা লিখে নিতে পারেন, টেন টু ফিফটিন ক্রোরস্ আমাদের কোম্পানি এই প্রোজেক্টে খরচ করছে। যা রিটার্ন আসবে সেখান থেকে সেন্ট্রাল গভমেন্ট আর ওয়ার্ল্ড টাইগার প্রোজেক্টে একটা ফান্ডিং করা হবে। টাইগার বাঁচানোর জন্য রেনুজি ফিলিম স্টারদের, ক্রিকেটারদের চিটঠি লিখে লিখে টাকা আনছেন আর অ্যাডপ্ট করাচ্ছেন বটে – কিন্তু সেটা আর কতদিন চলবে। একটা অল্টারনেটিভ তো ভাবতে হবে – কমন পিপুলকেও ইনভলভ্ করাতে হবে।’ সমু দেখল দুটো বাঘের শরীরেই পারিখের কোম্পানির লোগো লাগানো আছে। যে ফাস্টফুড কর্নার লাগানো হয়েছে সেখানে চকলেট থেকে কাটলেট – সবেতেই কোম্পানির গন্ধ ম ম করছে। প্রথম দিন ওপেনিং বলে ফ্রি। সুবেশী তরুণীর হাত ঘুরে দুটো চকলেট সমুর পকেটেও জমা পড়েছিল। তারই একটা চিবোতে চিবোতে আবার ধোনিকে দেখতে পেল সমু – একটা ল্যাম্প পোস্টে ঝুলছেন। আচ্ছা ওর পাশে যে বাঘটার ছবি দেওয়া আছে তা কি ওর পোষ্যপুত্র অগস্ত্যর? ধোনি কি কোনও দিন তার এই পশুপুত্রকে দেখতে যাবার সুযোগ পেয়েছে? অবশ্য পুত্র হলেও ছুঁয়ে ছেনে দেখার ব্যাপারটা এই দত্তক নেবার ব্যবস্থায় নেই। কর্ত্তৃপক্ষ শুধু পশুপালনের থোক টাকাটা পেলেই খুশি। এ যেন বাপ থেকেও নেই। বনের রাজার কী দুর্দশা! – এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে নিজের সঙ্গে কথা বলে চলে সমু। হঠাৎ খেয়াল হল, বাসটা নড়ছে না বেশ কিছুক্ষণ। গণেশগুড়ি বাজারের এ-দিকটা এমনিতেই কনজেসটেড। প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তা বেশ সরু। এরমধ্যেই গাড়ির তিন-চারটা লাইন হয়ে গেছে। এছাড়া স্কুটার-বাইক তো আছেই। উল্টোদিক থেকে অবশ্য ট্রাফিক চলছে, তবে ধীর গতিতে। দু-তিন মিনিট পর সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। একটা বিচ্ছিরি অবস্থা। আবার কোথাও গোলমাল বাঁধল না তো! চট করে ঘড়ি দেখে নিল সমু – বারোটা দশ। এমনিতেই অফিসের দেরি হয়ে গেছে। এই জ্যামে ফেঁসে গেলে চাকরি নট হয়ে যাবে। সম্পাদকটি একেবারে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার । এর থাবা থেকে বাঁচতে হলে এই অস্বাভাবিক জ্যামের একটা রিপোর্টিং করে নেওয়া যায়। তাহলে নেমে দেখতে হয় এই জ্যামের কারণটা কী – তেমন কিছু পাওয়া গেলে পথচলতি দু-চারজনের বাইট নিলেও ভাল খাবে মালটা। বাসের পা-দানিতে দাঁড়াতেই একটা হৈ হৈ আওয়াজ শোনা গেল। সমু মুখ বাড়িয়ে দেখল, একদল জনতা দৌড়ে এদিকেই আসছে – তাদের পেছনে সম্ভবত পুলিশের ডান্ডা পড়েছে। সে দ্রুত নেমে গিয়ে ওই জনতার ভিড়ে মিশে গেল। দুই এই শহরে রতনদের দিন যেভাবে শুরু হয় সেভাবেই আজও শুরু হয়েছিল। বড় বড় ড্রামগুলোকে সাইকেলের পেছনে দুপাশের ক্যারিয়ারে বেঁধে ঠেলে ঠেলে নিচে নামিয়ে আনা। খাটাল থেকে দুধ ড্রামগুলোতে ভরে কলোনির দিকে রওয়ানা। এক ড্রাম মিষ্টির দোকানে আর অন্য ড্রামটি মাসকাবারি গাহেকদের বিলিয়ে এগারোটা নাগাদ বাজার থেকে সবজি কিনে আবার সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে পাহাড়ে ওঠা। রতনের ঘর একটা অদ্ভুত ভৌগোলিক প্যাটার্নে দাঁড়িয়ে। ওপরে তার বুড়ো মা-বাবা আর এক ভাই তার বউকে নিয়ে থাকে আর নীচে তার নিজের সংসার। সোজা অনেকটা ওঠার পর সরু পাহাড়ি রাস্তাটা বাঁদিকে ঘুরলেই একটা পাথরের আড়ালে রতনের একটুকরো পরিচ্ছন্ন উঠোন। একেবারে পাহাড়ের গায়ে তার দু-কামরার একচালা ঘর, দরমার বেড়া – ওপরে টিন। ঘরের পাশে একটা মোটা নল ঝোলানো আছে। ওটা দিয়েই ঝরনার জল ওপর থেকে নীচের চৌবাচ্চায় ঢালা হয়। ঝরনাটা আছে পাহাড়ের অন্য ঢালে। তার পাশেই রতনদের ওপরের ঘর। ওঘরে যেতে হলে রতনের উঠোন পেরিয়ে আর এক বাঁক ঘুরে ওপরে উঠতে হয়। সেখানেও দুটো ঘর। তবে জায়গা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকায় ছাগল রাখবার চালাটাও ওপরেই করেছে রতন। সেটাও দরমার বেড়া দিয়েই ঘেরা। ঝরনাটা ওই ঘরের পাশে। শীতকাল বলে খুব একটা জল আসে না। সারাদিনই টিপটিপ করে পড়ে। রতন ছাগলের ঘরের পাশে পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট জায়গা টিনের টুকরো দিয়ে ঘিরে দিয়েছিল। ওটাই এ-বাড়ির মেয়েদের স্নানঘর। সাধারণত ভোরের দিকে মেয়েরা কেউ স্নান করে না। বেলা গড়ালে রান্না-বান্না সেরে তবে স্নান। আজ রতনের বউ লছমি যাবে বাপের বাড়ি। ভোর ভোর রতনের সঙ্গেই বেরোবে বলে স্নানে গেছে। স্নানঘরে ঝোলানো চটের পর্দা সরিয়েই চিৎকার। এক দৌড়ে শ্বাশুড়ির বিছানায় উঠে ‘দরজা বন্ধ গরনুস, দরজা বন্ধ গরনুস’ বলে চেঁচাতে শুরু করেছে। রতন সবে সাইকেলে দুধের ড্রাম দুটো বাঁধছিল। চিৎকার শুনে সাইকেল ফেলেই উঠে এসেছে – ‘কে ভয়ো, কে ভয়ো লছমি?’ লছমি শ্বাশুড়ির বুকে মাথা রেখে কোনও মতে স্নানঘরের দিকে হাত তুলে বলল, ‘মানছি ছ’। ‘মানছি!’ মানুষ এখানে কোথা থেকে আসবে! দু-ঘর আছে অনেক ওপরে। ওদের কেউ এখানে স্নান করতে আসার কথা নয়। নীচের বাঁকটায় যারা থাকে তারাও সাতসকালে স্নান করার জন্য ওপরে উঠে আসবে না। তাহলে কোন মানছি এল? রতনের ভাই সুরজও মুখে ব্রাস নিয়ে উঠে এসেছে। চারদিকে আলো থাকলেও কুয়াসার জন্য স্নানঘরের কোণটা একটু অন্ধকারই। সে একটা লাঠি নিয়ে এগিয়ে গেল। স্নানঘরের পর্দা সরিয়ে যা দেখল তাতে অন্য কেউ হলে ভিরমি খেত। সুরজ সন্তর্পণে পিছিয়ে এল। তার চোখে মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ। দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা কথাই বলতে পারল,‘বাঘ হুনছ’। কথাটা বলেই সুরজ নিচে দৌড় লাগালো। কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব দাঁড়িয়ে থেকে রতন দৌড়ে উঠল মায়ের ঘরে। ভেতর থেকে কুকরিটা নিয়ে একলাফে বাইরে। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে বলল। বাবাকেও ঘরের বাইরে আসতে বারণ করল। ওদিকে ছাগলগুলো ম্যাঁ ম্যাঁ করে চিৎকার করছে। এমনিতে সুরজের সঙ্গে এটাই ওদের বেরোবার সময়। কিন্তু এ হৈ-চৈ বাইরে বেরোবার আনন্দে নয় – একটা অস্বস্তি বা অজানা ভয়ের। ইতিমধ্যে সুরজের সঙ্গে টাঙ্গি, ছোট বল্লম, হাত-দা, ভোজালি ইত্যাদি অস্ত্র সম্ভার নিয়ে অনেকেই পৌঁছে গেছে অকুস্থলে। কেউ একজন জোরে জোরে ক্যানেস্তারা বাজাচ্ছে। সবারই চোখ স্নানঘরের দিকে। দেখতে দেখতে লোক জমায়েত হয়ে গেল। কিন্তু বাঘের সাড়াশব্দ নেই। কেউ এগোতেও সাহস করছে না। এর মধ্যে একজন একবাক্স চকলেট বোম নিয়ে এসেছে। দুটো ফাটানো হল। এবার বাঘ বাছাধনের বেরিয়ে আসার কথা। কিন্তু কোথায় কি! ছাগলগুলো বোমের আওয়াজে ভয় পেয়ে চুপ। এবার স্নানঘর লক্ষ্য করে আধলা ইঁট ছোঁড়া শুরু হল। তাতেও কোনও আওয়াজ নেই। কেউ কেউ বলতে শুরু করল, আদতে বাঘ ছিল তো ওটা – না কি অন্যকিছু? কিন্তু দু-দুটো লোক তো আর মিথ্যে বলবে না। তাহলে বাঘের হলটা কী? এবার দু-একজন সাহসী ছেলে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল লম্বা বাঁশ নিয়ে। চটের পর্দাটা খোঁচা দিয়ে ওঠাল। ও মা, বাঘ কোথায়?! স্নানঘর তো খালি। সবাই মিলে এবার এগিয়ে গেল। ঠিকই তো! বাঘ কোথায়? কথা শুনে লছমিরাও বেরিয়ে এল। কোথাও বাঘের দেখা নেই। ছেলের দল হৈ হৈ করে বাঁক ঘুরে রতনের উঠোনে নামতে যাবে – ঠিক এমনি সময় নীচ থেকে কেউ চেঁচিয়ে উঠল ‘বাঘ, বাঘ’। প্রায় পাঁচ হাত লম্বা প্রাণীটিকে তখ্খুনি দেখা গেল এক লাফে রতনের ঘরে ঢুকে যেতে। পূর্ণ বয়স্ক নয় বোধহয়। কিন্তু বাঘ তো। কেউ চট করে এগোল না। কেউ খোলা দরজা দিয়ে পর পর কয়েকটা বোম ছুঁড়ে দিল। সঙ্গে পাথরও ছুঁড়ল কেউ কেউ। বোমের শব্দেই বোধহয় বাঘটা বেরিয়ে এল। কিন্তু কোথায় যাবে, চারদিকে লোক। চৌবাচ্চাটার পেছনে গিয়ে লুকোল। এবার পাথর, বল্লম, হাত দা ইত্যাদি ছোঁড়া শুরু হল বাঘটাকে লক্ষ্য করে। হঠাৎ বাঘটা দু-পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই একটা বল্লম গিয়ে বিঁধল গলার কাছটাতে। একটা লাফ দিয়ে বাঘটা এসে পড়ল চাতালের খোলা জায়গায়। শুরু হল বাঁশ, লাঠি , দা ইত্যাদি দিয়ে নির্মম প্রহার। প্রথমে একটু দূর থেকে, তারপর কাছ থেকে। এই ব্যাপার চলল যতক্ষণ না বাঘটা নিস্তেজ হয়ে গড়িয়ে পড়ল। এটা একটা বাচ্চাই। মরে যাবার পর এবার সবার খেয়াল হল যে ফরেস্ট অফিসারকে খবর দিতে হয়। কে যাবে অফিসে? ফোন নম্বর কেউ কি জানে? কীভাবে জানবে। পাহাড়ে বাঘ নামতে পারে ভেবে ফরেস্ট অফিস থেকে ফোন নম্বর দিয়ে গেছে নাকি? কেউ বলল ১০৮এ খবর দিতে। থানাতেও জানানো যায়, কিন্তু সবচেয়ে ভালো গাঁওবুড়ার কাছে যাওয়া। রতন সবাইকে বলে দিল, ‘খবরদার! বাঘের বাচ্চাটা যে ঘরে ঢুকেছিল সেটা যেন কেউ না বলে। বলতে হবে ছাগল খেয়ে পালাচ্ছিল।’ সুরজের এক বন্ধু বলল,‘বাঘটাকে কুয়োয় ফেলে দিলে কেমন হয়? বলব যে রাতে কীভাবে কুয়োতে পড়ে গেছে জানি না। বাঁচাতে গিয়ে আমরা বাঁশ নামিয়েছিলাম, তাতে খোঁচা খেয়েছে।’ একদল এতে সায় দিল। কিন্তু রতনের কথা হল, বল্লমের দাগটার কী হবে। ফরেস্টের বাবুরা তো বুঝে ফেলবে। শেষে ঠিক হল যে, বলতে হবে বাঘটা ছাগলগুলোকে খেতে এসেছিল। রতন আর সুরজ ছাগল বাঁচাতে গেলে বাঘটা তাদের ওপর হামলা করে। তখন এরা আত্মরক্ষার জন্য কুকরি মারে। তাদের চিৎকারে লোকজন জড়ো হয়ে যায় আর বাঘটাকে অনেক কসরত করে মেরে ফেলে। নাহলে সুরজ বা রতন কারও একজনের জান চলে যেত। খবর পাওয়ার প্রায় চারঘন্টা পর কাছের ফরেস্ট বিট অফিস থেকে চারজন ফরেস্ট গার্ড ওঠে পাহাড়ে। সব বয়ান লিখে নিয়ে মরা বাঘটাকে বাঁশে বেঁধে নিচে নেমে আসে। এখন প্রথামাফিক কাজগুলো সেরে তারপর তদন্ত শুরু হবে – কেন বাঘেরা লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। মানুষের হাতে বাঘের অহেতুক মৃত্যু এড়াতে হয়ত পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযানও শুরু করা হতে পারে। তবে এখন বাঘটাকে ঘিরে যেন একটা বিজয়োৎসব চলেছে। রতন, সুরজ তো আছেই – সঙ্গে ওই পাহাড় আর তার সমতলের লোকেরাও আছে। খবর পেয়ে কয়েকটা নিউজ চ্যানেলও চলে এসেছে – পাহাড়ে বাঘ হত্যা একটা বড় খবর। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়ছে সমদলে। বড় রাস্তায় ভিড়টা নামতেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। ভিড়ের জন্য গাড়ির যাওয়া আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। পুলিশ এই ভিড়কে সামলাতে লাঠি নিয়ে তাড়া করে যেতেই পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে গেল। লোকজন এদিক ওদিক ছুটতে আরম্ভ করল। পথচারি দু-একজন এদের জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে?’ এরা সংক্ষেপে সারল,‘বাঘ, বাঘ’। আর যায় কোথায়, সবাই ছুটতে লাগল ‘বাঘ, বাঘ’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে। তিন দুপুর না গড়াতেই আজ রশ্মি প্রীতমকে নিয়ে পার্কে ঢুকেছে। ঘড়িতে তখন পৌনে বারোটা। শীতের রোদ এই সবুজে ঘেরা নিরালায় বেশ ভালোই লাগে। কলেজ পালিয়ে পার্কে আড্ডা দেওয়ার এটাই বেস্ট সময়। এখন কচিকাঁচাদের নিয়ে বুড়োরা আসে না। ওদের ভিড়টা হবার আগেই এরা এখান থেকে বেরিয়ে যাবে। সবুজ বুশের ঘেরাটোপে রশ্মি নীল ওড়না বিছিয়ে দেয়। প্রীতম পপকর্নের ঠোঙাটা এগিয়ে দেয় রশ্মির দিকে। দুজনে গল্প করতে শুরু করে – ক্লাসের, সিনেমার, মিউজিক অ্যালবামের আর গরম খবরের। প্রীতম বলে, ‘আজ টিকিট কুড়ি টাকা করে নিল। কেন জানিস?’ রশ্মি মুখ তোলে। প্রীতম বলে,‘আজ থেকে এখানে টাইগার পয়েন্ট হচ্ছে, বাচ্চাদের অ্যামিউজমেন্টের জন্য, আজকের কাগজে পড়িসনি?’ রশ্মি বলল,‘সেটাতো বাচ্চাদের জন্য, আমাদের জন্য তো নয়!’ প্রীতম খেপায়,‘তোর অ্যামিউজমেন্টের জন্য তো আমিই আছি। বাঘের মতো হালুম করে ঝাঁপিয়ে পড়ব ঘাড়ে।’ রশ্মি ভয় পাওয়ার ভান করে সরে যায়। বলে,‘যদি সত্যির বাঘ আসে না, তবে তোর ওই হালুম করা বেরিয়ে যাবে।’ প্রীতম চেঁচিয়ে ওঠে ‘বাঘ, বাঘ’। আর এক দৌড়ে ওখান থেকে ছুটে বেরোয়, রশ্মিকে ফেলে রেখেই। রশ্মি হেসে গড়িয়ে পড়ে প্রীতমের এই কান্ড দেখে। ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে বলতে থাকে ‘ভীতু, ভীতু কোথাকার।’ কিন্তু পুরোটা বলা তার হয়ে ওঠে না। হাসির দমকটা তার গলাতেই আটকে যায়। সে দেখে একটা বাঘ তার চার-হাত দূরে। বাঘটা তার দিকে তাকিয়েই মাটিতে লেজ আছড়াচ্ছে। একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ করে রশ্মি ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পার্কে তখন খুব একটা লোক নেই। প্রীতমদের মতোই বেশিরভাগ। প্রীতমের চিৎকারে সবাই সজাগ হয়ে ওঠে। ঠিকই একটা বাঘ ধারের সবুজ ঝোপটার কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর লম্বা লেজটাকে মাটিতে আছড়াচ্ছে। এই বাঘটা যে আসল, পার্কের অন্য ধারে ফাস্টফুড কর্নারের পাশে দাঁড়ানো কোম্পানির ছাপ মারা বাঘগুলোর মতো যে মোটেও নয় – সেটা বুঝতে ওদের কারোরই বেশি সময় লাগল না। এরাও পড়ি-মরি করে এক দৌড়ে পার্কের বাইরে চলে গেল। মুহূর্তে মানুষ জমায়েত হয়ে গেল পার্কের বাইরে। কাউন্টারের লোকটি ভিড়ের প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে কাউন্টার বন্ধ করে দিল। কেউ সাহস করে ভেতরে যাচ্ছে না। এর মধ্যে প্রীতমের বন্ধুরা কলেজ থেকে দল বেঁধে চলে এসেছে। ওরা এসেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। একজন গেটের ওপর চড়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল,-- ‘ওই তো বাঘটা, এখন এদিকে আসছে।... না রশ্মিকে দেখা যাচ্ছে না। খেয়ে ফেলেছে বোধহয় রে....।’ আর একজন গেটের ওপর চড়ে বসল। তার মনে হল বাঘের মুখটা রক্তের মতো লাল, নিশ্চয়ই রশ্মিকে খাওয়ার চিহ্ন। চেঁচিয়ে সেটা সবাইকে জানাল। প্রীতমের এখন একটা বিধ্বস্ত অবস্থা। সে পার্কের গেটের সামনে বসে পড়ে কাঁদতে লাগল। চার সমু বাস থেকে নেমে স্বচক্ষেই দেখল সবকিছু। বনকর্মীদের কাঁধে বাঘের শেষযাত্রার কয়েকটা ছবিও তুলে নিল। সে যখন ছবি তুলছে তখন পাশ থেকে এক বুড়ো ভদ্রলোক আলগোছে একটা মন্তব্য ছুঁড়ে দিলেন,‘বাঘেরা বনে সুন্দর, খাদক শহরে....।’ সমু ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল – ‘ঠিকই বলেছেন।’ মনে মনে ভাবল এটাই তার নিউজের একটা ভালো ক্যাপশন হয়ে যাবে – ভালো খাবে পাব্লিক। এ-সময়েই তার পকেটে মোবাইল বেজে উঠল। সর্বনাশ, নির্ঘাত সম্পাদক বুড়ো। মোবাইল খুলে দেখল তারই এক সাংবাদিক বন্ধু। যাক বাবা, বাঁচা গেল। ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে উত্তেজিত গলা – ‘কোথায় আছিস, শিগগির নেহেরু পার্কের সামনে চলে আয়। পার্কে বাঘ। একটা মেয়েকে খেয়ে ফেলেছে বোধহয়।’ সমুর কথাটা বিশ্বাস হল না। বন্ধুটি মাঝে মাঝে এমন ইয়ার্কি করে থাকে, তিন তিনবার বললেও ধন্দ কাটে না-- ব্যাপারটা সিরিয়াস না পলকা। তাই সে বলল,‘ইয়ার্কি মারিস না। ওটা পারিখের বাঘ। কাল রিপোর্ট করে দিয়েছি, আজ নিউজ বেরিয়েও গেছে। পেপার খুলে দেখ, থার্ড পেজে তোর পার্কের বাঘটা আছে।’ ‘নারে। ইয়ার্কি করছি না। একদম সিরিয়াস। এই যে শোন, যে ছেলেটা ওর বান্ধবীকে নিয়ে পার্কে গিয়েছিল তার ভয়েস।’ সমু শুনল, সত্যিই খুব চেঁচামেচি হচ্ছে। আর একটা ছেলে কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘বাঘটা আমার রশ্মিকে খেয়ে ফেলল রে, ওরে তোরা কেউ বাঁচা ওকে।’ বন্ধুটি আরও বলল যে বাঘটাকে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। ফোন বন্ধ করে সমু ভাবল, কী গেরো রে বাবা! একই দিনে শহরের দু-প্রান্তে বাঘ নামল! বন্ধুর দুই আর ফোনে শোনা ছেলেটির চেঁচানো মিলিয়ে তিনবার বাঘ থাকার কথা তো জানাই গেল। ব্যাপারটা তাহলে সত্যি। সে খুঁজতে লাগল কীভাবে তাড়াতাড়ি নেহেরু পার্কে পৌঁছনো যায়। উল্টোদিকে একটু হেঁটে গিয়ে এক বাইকওয়ালাকে পাওয়া গেল। তাকে বাঘের তান্ডবের কথা বলতেই সে নিয়ে যেতে রাজি হল। বাইক ছুটল জু-রোড ধরে। অনেকটা ঘুরে পৌঁছনো গেল নেহেরু পার্কে। ওখানে তখন সাংবাদিক সহ অনেক মানুষের জটলা, চার-পাঁচটা টি.ভি চ্যানেলের লোকেরা তো আছেই। সমু বন্ধুকে খুঁজে নিয়ে ওই জটলায় ঢুকে গেল। তাকে বলল,-- ‘আজ একটা জব্বর রিপোর্টিং হবে। সম্পাদক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করার সপক্ষে একটা জোরালো সম্পাদকীয় লেখার সুযোগ পেয়ে যাবে। এদিকে বাঘের ঘায়ে মানুষ ঘায়েল, ওদিকে মানুষের ঘায়ে বাঘ। মাঝখানে পারিখ। ভালোই জমেছে।’ প্রীতমের পেছন পেছন পার্কের ভেতর থেকে যারা বেরিয়ে এসেছে, কয়েকজন তাদের জিজ্ঞেস করছে,‘কি হয়েছে ঠিক করে বলো। মেয়েটাকে কি বাঘে খেয়েছে?’ এরা এতটাই নার্ভাস যে ঠিক ভাবে কথাই বলতে পারছে না। সমু চেষ্টা করল সেখান থেকে কিছু খবর বার করার। আতঙ্ক ছাড়া স্পষ্ট কিছুই পাওয়া গেল না। শীতের সময়। শহরের চারদিক ঘেরা পাহাড়গুলো থেকে প্রায়ই বাঘ নেমে আসে লোকালয়ে। কারও বাড়ির ছাগল বা মুরগি ধরে খাবার কথাও শোনা যায়। কিন্তু এই নেহেরু পার্কে কোনওদিন বাঘ ঢুকতে পারে তা কল্পনারও বাইরে। কিন্তু সেই বাঘ ঢুকেছে এবং মানুষও খেয়েছে – সেটা সত্যি। কেন কদিন আগেই তো চিড়িয়াখানায় ছবি তুলতে গিয়ে একটা লোক বাঘের খাঁচায় হাত বাড়িয়ে প্রাণটা খোয়ালো না! সেটা তো খাঁচার বাঘ। আর এটা ছাড়া পাওয়া – একেবারে জঙ্গলের আসল জিনিস। ও মানুষ পেলে খাবে না এমন কোনও গ্যারান্টি তো নেই। চারপাশে জমে যাওয়া ভিড়ের এইসব টীকা-টিপ্পনির মাঝেই পুলিশ এসে গেল। তার আগে কলেজ থেকে কয়েকজন টিচারও ঘটনাস্থলে এসে গেছেন। তাঁদেরই কেউ সম্ভবত থানায় খবর দিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ এখানে করবে কী? তারাও ভেতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। এটা একমাত্র ফরেস্ট গার্ডরাই পারে। ওদের সঙ্গে ঘুম পাড়ানো বুলেট চালানোর জন্য ভেটেরিনারির ডাক্তার থাকে। তাকে দিয়ে বাঘ ঘায়েল করা সম্ভব। আর পুলিশ এমনি গুলি চালালে বিপদ। বাঘ মারার দায়ে জেল হয়ে যেতে পারে। তাই কোনও পুলিশই এগোচ্ছে না। তারা ভিড়টাকে সামলাবার চেষ্টা করল। ছাত্রদের সঙ্গে কয়েকবার কথা কাটাকাটিও হয়ে গেল তাদের। ছাত্ররা খেপে গিয়ে রাস্তায় বসে পড়ল। তাদের দাবি, রশ্মিকে উদ্ধার করতে হবে। পুলিশ প্রশাসন কাজে অবহেলা করছে। ট্রাফিক যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেল নিমেষেই। খবর গেল চিড়িয়াখানায়, ফরেস্ট অফিসে। এরা লোক পাঠাচ্ছি বললেও ঘন্টাখানেক। কারণ শহরের জানজট ঠেলে অতদূর আসাটাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এদিকে যত সময় যাচ্ছে জনতা তত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। থানা থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনি চলে এল এদের সামলাতে। চারদিক থেকে নানাভাবে লোকে দেখতে চেষ্টা করছে মানুষখেকো বাঘটাকে। পুরো চত্বরটাকে পুলিশ ঘিরে ফেলল। পাশের পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে উঠে গিয়ে কেউ কেউ দেখল, সত্যি বাঘটা পার্কে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কখনও বসছে। আবার উঠে চক্কর মারছে সারা পার্ক জুড়ে। কারও কারও মনে হল ঝোপের মধ্যে একটা মেয়ের আধখাওয়া শরীর পড়ে আছে। ঝোপের ফাঁকে রশ্মির নীল ওড়নাটা মাটিতে লুটোতে দেখা যাচ্ছে। সব খবরগুলো নানা দিক থেকে মোবাইলে গেটের বাইরের জমায়েতের কাছে চলে আসছিল আর উত্তেজনার পারদ চড়ছিল। শেষ পর্যন্ত আধা সামরিক বাহিনির লোকেরা এসে ভিড়কে ঠেলে সরিয়ে জায়গাটা খালি করে ফেলল। বারে বারে মাইকে ঘোষণা করা হল সবাইকে সরে যেতে। বড় বড় নো পার্কিং বোর্ড দিয়ে চারদিকে সাধারণ মানুষের যাওয়া আসা বন্ধ করে দেওয়া হল। ফায়ার ব্রিগেডও হাজির। খবর পাওয়া গেল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে নাকি লোক এসে গেছে। বাঘটাকে বোধহয় মেরেই ফেলতে হবে। বেকায়দায় পড়লে আর কি করা যাবে। তবে ঘুম পাড়ানো গুলি দিয়ে শোয়ানোর চেষ্টাই আগে করা হবে। একটা বড় খাঁচাসহ গাড়ি গিয়ে দাঁড়ালো পার্কের গেটে। সমস্তটা প্ল্যান করে নিতে আরও পনেরো মিনিট। এরপর সাবধানে গেট খুলে পাঁচ জন পাঁচ জন করে চারটে ফরেস্ট গার্ডের দল ঢুকে গেল পার্কে। পোজিশন নিল। বাঘটাকে দেখতে পাওয়া গেল ঝোপের ওধারেই গোল হয়ে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতেই মাঝে মাঝে বসছে, লেজ আছড়াচ্ছে। পার্কে বন্দুক হাতে লোক দেখে বোধহয় একবার তাকালো। অমনি গার্ডরা মাথা নিচু করে বসে পড়ল। বাঘ যদি মানুষের গায়ের গন্ধ পেয়ে যায় বা দেখে ফেলে তবে বিপদ। বাঘটা এবার পার্কের সামনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তবে একটু এসেই আবার পুরনো জায়গায় চলে গিয়ে আগের মতোই চক্কর কাটতে শুরু করল। এবার রাইফেলধারী ডাক্তার ও গার্ডরা আরও একটু এগিয়ে গেল। উদ্দেশ্য কাছ থেকে ঘুম পাড়ানি বুলেট চালানো। মওকা পেয়ে ডাক্তার ঠিক দু-চোখের মাঝখানটা তাক করে গুলি ছুঁড়ল। লাগল। কিন্তু বাঘটা তো দাঁড়ালো না! আঘাত পেয়ে চিৎকার বা লাফ কোনওটাই দিল না। তবে কি ওটা লাগেনি! লক্ষ্য ভুল হবার তো কথা নয়। ওরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকালো। ওষুধ-গুলিটা লাগলো না বোধহয়। ওদিকে বাঘটা ঘুরতে ঘুরতেই এবার দিল ছোট্ট একটা লাফ । তারপর দু-পায়ে ভর দিয়ে একবার দাঁড়ালো। অফিসার নির্দেশ দিলেন ‘ফায়ার’। এবার ডাক্তার নতুন একটা ভায়েল চালালো। বাঘটা পড়ে গেল মাটিতে। আর উঠল না। অফিসার সহ গার্ডরা দৌড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ওরা বাইরে বেরিয়ে আসছেন হাসতে হাসতে। কিছুক্ষণ আগের টানটান উত্তেজনার ভাবটা আর নেই। সমুরা গেটের বাইরে অপেক্ষাই করছিল এদের জন্য। অফিসারটি ওদের দেখে এগিয়ে আসতেই এক ঝাঁক প্রশ্ন উড়ে এল,-- ‘বাঘটাকে কি মেরে ফেললেন না ঘুম পাড়ালেন? বাঘটা কোথায়? মেয়েটা কোথায়? মেয়েটার কী অবস্থা? মেয়েটা কী মরে গেছে? বাঘ ওর কতটা খেয়েছে?’ অফিসার হাত তুলে সবাইকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন,‘বাঘটা পারিখ অ্যান্ড পারিখ কোম্পানির একটা সারপ্রাইজ। উন্নতমানের কম্পুটারাইজড্ পুতুল।’ -------------------

No comments:

Post a Comment

Note: only a member of this blog may post a comment.