গুণধরের অসুখ
ধরা পড়েছিল অনেক আগেই শুধু জানা ছিল না অসুখটা ছোঁয়াচে। এই ছোঁয়াচটা আবার যা-তা রকমের নয়। এ-নাকি আমাদের সবার শরীরেই বসে আছে চুপটি করে। শুধু অপেক্ষা এক আশ্চর্য যাদুকরের। তার রউ চাঁড়ালের হাড়ে রয়েছে সেই আশ্চর্য শক্তি যা এক লহমায় সুস্থ-সবল মানুষটিকে মাটিতে পেড়ে ফেলতে পারে, আর তাকে গোল করে দাঁড়ানো সভ্য মানুষের ঢল তখন খাঁচার পশু-দেখার মতো দূর থেকে আদর করে, সহানুভূতি দেখায় আবার কখনও দূর-ছাই করতেও ভোলে না। যাদুকরের হাড়ে আছে অসীম শক্তি। সে ঠিক তক্ষুনি সবার অলক্ষ্যে অসুখটা ঢুকিয়ে দেয় ওদের শরীরে। সেটা দেখে মাটিতে শুয়ে শুয়ে অসুস্থ মানুষটি হাসে, হাসে, হাসে। পাগল আর কাকে বলে?
পূর্ণচন্দ্র সরকার, ইংরেজিতে যিনি full moon government তিনি উপভোক্তাদের কাছে এক এক পরিচয়ে ধরা দেন। আপনি কবি তো উনিও কবিতার ভক্ত, আপনি নাট্যকার তো উনিও বড় অভিনেতাদের সঙ্গে ওঠবোস করেন, আপনি house-wife তো উনি house- husband। কোনও মান নেই অপমান নেই, আত্মপর ভাব নেই -- শুধু product বিক্রি হলেই হল। নাট্যকারের কাছে তাঁর আসা নাটক নিয়ে কথা বলতে, মনে আশা যদি মালগুলো উতরে যায় বা যদি একবার মুর্গি বানিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু যাঁর কাছে তিনি গিয়েছেন তিনি তো সেয়ানা পাগল। তাই ধরে ফেলেন যে, এ ব্যাটা নাটক নিয়ে কথা বলার নামে নাটক করতেই এসেছে। নিজে তিনি মুর্গি হবেন না আর পরে অন্যদের মুর্গি বানানোর খেলায়ও মাতবেন না। তাই ফুলমুন যাবার বেলা বিড়বিড় করে বলতে বাধ্য হয় -- 'আচ্ছা পাগল লোক'। আমরা কেউ কেউ তাকে সমর্থন করছি। সত্যি তো, যেমনই হোক নাট্যকারের উপকার সে সেধেই করতে গিয়েছিল -- অপকার তো নয়। আজকের দিনে কে না চায় দুটো পয়সা আয় বাড়াতে। দু-টাকা invest করে যদি পাঁচটাকা আসে তাতে লাভ তো সেই লোকেরই, নয় কি? কিন্তু নাট্যকার সেয়ানা লোক (তিনি কবি বা ঔপন্যাসিক হলেও কিছু আসত-যেত না) -- আমাদের মনের কথা পড়ে ফেলতে তাঁর জুড়ি নেই। তিনিও বিড়বিড় করে নিশ্চয়ই বলছেন -- 'সব গুনধরের দল'।
অথবা ধরে নেওয়া যাক, আমরা কেউ এঁদের দুজনকে চিনি না। বেপাড়ার হতে পারে। তবে মাছ বাজার হয়ে সব্জি বাজারের বটপাতা-মার্কা চত্বরটায় সপ্তাহের কোনও না কোনও দিন দেখা হয়ই। তা থেকে মুখ চেনা। দুজনেই সাজে , পোষাকে, হাবে এবং ভাবে নিপাট ভদ্রলোক। পাগলের যা-যা সাধারণ লক্ষণ (বলে বিবেচিত সুস্থদের কাছে), -- যেমন মাসের পর মাস গায়ে জল না দেওয়া আলুথালু চেহারা, গায়ে গরমে কিছুই নেই আর শীতে ছেঁড়া চাল-ডালের বস্তা, কোমরের অতীব নিচু অঞ্চলে কোনও মতে লেপটে থাকা একটা শতচ্ছিন্ন প্যান্ট-জাতীয় পরিধেয়, খাদ্যের পাত্র নালা-নর্দমা বা রাস্তার ধার এবং যে জলটাই শুধু বিশুদ্ধ খাবার চেষ্টা করে রেল স্টেশনের নল বা রাস্তার টাইম-কল অথবা পাতকো থেকে -- এর কোনওটাই এ-দুজনের নেই। সরাসরি আমাদের লাভেও এঁরা নেই, লোকসানে তো নয়ই। পাড়ার বাচ্চাদের আমোদের বস্তুও এঁরা নন। এঁদের পাগল বলি কোন সাহসে।
একবার সবুজ পাহাড়ের কোলে হলুদ দোতলা বাড়ির একতলার বারান্দায় একটি অস্থিরমতি ছেলেকে আপনারা দেখেছিলেন। তখন বৃষ্টি, অঝোরে। ঢালের পাকা রাস্তা বেয়ে খরস্রোতা নদী নেমে আসছে নীচে। ছেলেটি বারবার জল দেখছে আর বলছে, --' ইস্ অবস্থা দেখেছো, কী কষ্ট বলো তো। একটু চা খাবে?' ছেলেটির বাবার কথাও নিশ্চয়ই মনে পড়বে আপনাদের -- 'কেন বলছে বলো তো, তোমাদের যেতে কষ্ট হবে ভাবছে। মানুষ খুব ভালবাসে ও।' আপনারা সেদিন প্রশ্ন করেননি, ওকে কেউ ভালবাসে কি না। মনে মনে ভেবেছিলেন, বৃষ্টিটা ধরলে এই পাগলের হাত থেকে বাঁচি। কারণ যে কাজে আপনারা ছেলেটির বাবার কাছে এসেছিলেন সেটা তখন আদায় হয়ে গেছে। নিজের ভালো তো আপনাদের মতে পাগলেও বোঝে, তাই নয় কি? কিন্তু ছেলেটি নিজের চেয়ে আপনাদেরই বেশি ভালবাসে। পাগল আর কাকে বলে?
এই পাগলামোটাই আসলে গুণধর বা গুণধরের মতো আরও অনেকের অসুখ -- মানুষকে ভালবাসা। নিজেকে যতখুশি ভালবাসুন, কুছপরোয়া নেই। কিন্তু অন্যদের ভালবাসতে গেলে আপনার গুণধর হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
প্রদ্যোত চক্রবর্তীর নাটকটা সে-কথাই বলে কি না সেটা জানার জন্য 'গুণধরের অসুখ' পড়া ছাড়া উপায় নেই।
গুয়াহাটির প্রাগজ্যোতিষ কলেজে গুণধরকে চেনার কাজটা শুরু হল ৯ ফেব্রুয়ারি -- একান্তভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যই। কারণ মানুষ আর পাগলে প্রভেদ করাটা শিখতে হবে তাদেরই। পথ পড়ে রয়েছে আরও। নাটক সেই পথ আর পথের সত্যকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে শুধু।
No comments:
Post a Comment
Note: only a member of this blog may post a comment.