Wednesday, 17 June 2020

কালি গোঁসানির মাঠে


কালি গোঁসানির মাঠে
জ্যো তি র্ম য়    সে ন গু প্ত
                             এক
                             বৃষ্টি নামতেই কৌশিকদের ডাঙ্গুলি খেলাটা পণ্ড হয়ে গেল। ওরা সবাই এক ছুটে একচালাটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। গায়ে জলের ছাঁট লাগছে, মাথাটা তো বাঁচল! ওদের মধ্যে কৌশিকের ভয় সবচেয়ে বেশি -- এমনিতেই ওর সর্দির ধাত, তার ওপর বেড়াতে এসে বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরটর বাঁধিয়ে বসলে আর দেখতে হবে না। সে একেবারে একচালাটার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো জ্যাভলিনের মতো তেরচাভাবে এসে তার পা অথবা কাচাকাছি জায়গায় বিঁধে যাচ্ছে। একটু শীত শীত ভাবও আছে। পঞ্চারা একচালাটার ধারে, তাই সেগুলো তাদের গায়ে এসেই বিঁধছে। তার ওপর ওরা আবার চালার কার্ণিশ বেয়ে নেমে আসা জলের ধারাকে হাত দিয়ে টেনে নিয়ে নিজেদের শরীর ভেজাচ্ছে।
                             বীরু কৌশিককে জড়সরো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকল, “অ্যাই বুচু, আয় না এদিকে। কি মজা! ভিজবি আয়। কৌশিকের মনে মনে খুব বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে, কিন্তু সর্দি-কাশির ভয়। সেতো বাড়িতে থাকলে এ-সময় বাজে খাতার কাগজ দিয়ে নৌকো বানাত আর সুযোগ খুঁজত -- কখন মা একটু চোখের আড়ালে যাবে আর সে একছুট্টে গিয়ে উঠোনের জমা জলে নৌকোটা ভাসিয়ে আসবে। ইস্ দাদুর কথা মনে পড়ছে -- দাদুই তাকে কাগজের নৌকো বানানো শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ........
                             বলতে বলতেই পঞ্চা আর বীরু তাকে টানতে টানতে চালার বাইরে নিয়ে এল, ঠেলে ফেলে দিল ভেজা মাঠের জমা জলে। রোগা-পাতলা কৌশিক কোনো বাধাই দিতে পারল না। সে দু-তিনবার ওদের হাত ছাড়িয়ে চালার নিচে ঢুকে পড়ার বৃথা চেষ্টা করল। এরপর পঞ্চা-বীরু-তপু-পাপনরা মিলে তাকে মাঠের কাদাজলে ফেলে একেবারে হোলির কাদাখেলার মতো হুটোপাটি শুরু করে দিল। কৌশিকের গলি-ক্রিকেট খেলার জ্ঞানটা এবার কাজে এল। ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঙ্গল নেওয়ার মতো সে মাঠময় এদিক-ওদিক দৌড়তে লাগল ডানপিটে বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আর দলনেতা বীরুর পেছন পেছন পঞ্চা-তপু- পাপনরা। বুচুকে কাবু করে ফেলতে পারলে বীরু খুব মজা পায়। এমনিতে বুচু তার বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু লিকলিকে চেহারার বুচুকে সব খেলায় হারিয়ে বাজি জেতার আনন্দটাই  তার কাছে একটা আলাদা ধরনের মজা। কারণ বাজি জেতার জিনিসটা বুচু নিয়ে আসে পরের বার। এবার অবশ্য একটা পাঁচ নম্বর কসমস ফুটবল আনার কথা ছিল, আনেনি। ডাঙ্গুলি জেতার শর্ত তাই হয়ে গেল দুটো কসমস বল। কিন্তু বৃষ্টিটা বাধ সেধেছে। একটা সময় বুকে সাহস এনে কৌশিক ওরফে স্কুলের দৌড়ে বরাবরের লাস্টবয় বুচু চ্যালেঞ্জ করে ফেলল, ‘আমাকে ছুঁতেই পারবি না। অমনি চারটে গলা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল ‘বাজি·’ ‘হ্যাঁ বাজি। ‘হারলে কিন্তু দুটো বলই আনতে হবে, মনে রাখিস বুচু.......।
দুই
                             রেললাইনের ধারে এই মাঠটা খুব একটা বড়ো নয়। পুব মাথায় ফরেস্ট এরিয়ার ঘন জঙ্গল শুরু হয়েছে। একটা ট্রাক যাবার মতো কাঁচা রাস্তা ঢুকে গেছে ভেতরে। মাঝে মাঝে মস্ত মস্ত কাঠের লগ্ বোঝাই ট্রাকগুলো বেরিয়ে আসে, চলে যায় মাঠের ভেতর দিয়ে কোনাকুনি। পশ্চিমে সারসার একচালা -- ওখানে হাট বসে বুধবারে। দক্ষিণে একটা বড়ো পুকুর আর তার ওপারে রাস্তা, বড়িঘর বা জনবসতি।
                             মাঠটা সর্বজনীন -- মানে গ্রামের ছেলেদের খেলাধুলো, শীতকালীন মেলা বা যাত্রাপালা, ধোপাবাড়ির কাপড় শুকোনো, কখনও কোনো বাড়ির ধান বা গম ঝাড়াই-বাছাই করার জন্য রোদে দেওয়া ইত্যাদি সবই চলে। মাঠটার আদুরে ডাকনাম কালিগোসানীর মাঠ। না কোনো কালিমন্দির নেই ধারে কাছে। শোনা যায়, বহু আগে কছারি রাজাদের বংশে কোনো এক অকালমৃত শিশুকন্যাকে এখানে কোথাও অন্ত্যেষ্টি করা হয়েছিল, সে নাকি দেখতে ছিল কালো কুচকুচে। সেই থেকে মাঠের নামটা এরকম হয়ে গেছে। অবশ্য বাড়ির অবাধ্য বাচ্চাদের পোষ মানাতে বা কোনো ছোট্ট ছেলে বা মেয়ে যদি খাওয়ার বায়না করে, তো মা-ঠাকুমারা মাঠের দিকে আঙুল তুলে ভয় দেখায় কালিপেত্নির নামে -- যেন গোঁসানির মাঠ থেকে গুটি গুটি পায়ে তক্ষুনি কালি রাক্ষসী এসে হানা দেবে।
                             মাঠের নরম মাটিতে কোথাও লরির ভারি চাকা বসে গিয়ে ছোটোখাটো গর্ত তৈরি হয়েছে। রেল লাইনের ধারে উঁচু জমিতে অসংখ্য ধেড়ে ইঁদুরের গর্ত। কালিপুজোর রাতে ওই গর্তগুলো হয়ে ওঠে পঞ্চু-বীরুদের বিনোদনের উৎস। চারপাঁচটা চকোলেট বোমের সলতেয় একসঙ্গে আগুন ধরিয়ে গর্তের ভেতর চালান করে দেওয়ার অপেক্ষা শুধু। ব্যস, দু-এক মুহূর্ত পরে বু-উ-ম্ -- গর্তটা বড়ো হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে ধেড়েগুলোর তখন কী ছুটোছুটি! সঙ্গে পঞ্চু-বীরু-তপুদেরও নারকোলের লণ্ঠন নিয়ে পাল্লা দেওয়া। একবার কৌশিকও তাদের দলে যোগ দিয়েছিল একটা আঁচি-লণ্ঠন জোগাড় করে। প্রথমবার এই লণ্ঠন দেখে সে অবাক হয়ে গিয়েছিল।
                             আধমালা নারকোলের খোলার পেছনে ফুটো করে গিটারের স্টি˜ং-এর মতো সরু লোহার তার ঢুকিয়ে লম্বা করে ঝোলানোর ব্যবস্থা -- নারকোলের মালার খোলা দিকটার ভেতর একটা ছোটো মোম বসিয়ে তৈরি লণ্ঠন। বীরুরা এর নাম দিয়েছে আঁচি-লণ্ঠন। এ-জিনিস কৌশিকদের ফ্ল্যাটবাড়িতে দেখা যায় না। সেখানকার ছেলেমেয়েরা কালিপুজোর রাতে নানারকম বাজি পোড়ায়, রঙ-মশাল জ্বালে -- কিন্তু আঁচি-লণ্ঠন হাতে ঘুরে বেড়ায় না।
                             কৌশিক সেবার নানারকম বাজি নিয়ে গ্রামে দাদুর বাড়ি ছুটি কাটাতে গিয়েছিল। এর আগের বারই কোনো একটা বাজিতে হেরে সে কালিপুজোতে পোড়ানোর জন্য বাজি আনবে বলে কবুল করে গিয়েছিল। তা সেই বাজির বড়ো প্যাকেট থেকে সবগুলো মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গোঁসানির মাঠে বসে প্ল্যানিং হচ্ছিল কত নতুন নতুন ভাবে সেগুলো পোড়ানো যায়। ইঁদুরের গর্ত বড়ো করা, পুরনো গুঁড়ো দুধের কৌটো বা তেলের টিনের ভেতর রেখে চকোলেট বোম ফাটানো বা ছাগলের ল্যাজে মরিচ বোম লাগিয়ে ফটাফট জ্বালিয়ে দিয়ে তার তিড়িংবিরিং নাচ দেখার আমোদ তো ছিলই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল হাউই বাজি পোড়ানোর নানা অভিনব প্ল্যানিং।
                             যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পঞ্চু কোত্থেকে একটা শাবল নিয়ে এল -- ছয় ইঞ্চির মতো একটা গর্ত খোঁড়া হল,  কারণ বীরু সর্দার বলেছিল, ‘এক বিঘত গর্ত করলেই হবে। শুকনো খড় জোগাড় করে চারখানা হাউই বা রকেট একসঙ্গে বাঁধা হল। কৌশিক ওরফে বুচু আঁচি-লণ্ঠন এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বন্ধুদের ‘মদত করছিল। নির্জন মাঠের মধ্যে কেউ যদি ওদের এভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখত, নির্ঘাৎ ভুতের আলো ঘুরছে ভেবে সাংঘাতিক ভয় পেতো। একে অমাবস্যার রাত, তায় মাঠের পশ্চিম দিকে তেঁতুল গাছের জঙ্গলটার দিকে সবারই যাওয়া বারণ। আর কি না ডানপিটে ছেলেগুলো বাজি পোড়াতে পোড়াতে প্রায় চলে গেছে ওখানটাতেই!
                             সত্যি, কৌশিকদের খেয়ালই হয়নি ব্যাপারটা। মাঠের পশ্চিম সীমান্তে বেশ কয়েকটা ঝাঁকড়া কুলের গাছ। দিনের বেলা পাকা কুল পেড়ে খাবার জন্য পাঠশালা থেকে পালিয়ে কেউ কেউ ওখানে যেত। কুলগাছের জঙ্গল আর বাঁশঝাড়ের মাঝখান দিয়ে একটা নুড়িপথ আছে। হেডমাস্টারের চোখ এড়িয়ে কুল খেতে যাওয়া আর নির্বিঘ্নে তাড়াতাড়ি পাঠশালায় ফিরে আসা যায় ওই সরু রাস্তা দিয়ে। তিনি মোটা বেত হাতে বসে থাকতেন পাঠশালার সামনের বারান্দায়, তাঁর নাকের ডগা দিয়ে বীরু কেন একটা মাছিও গলতে পারে না। তাই নুন-মরিচ ডলে টসটসে পাকা কুল খাবার ইচ্ছে হলে ওরা বড়ো রাস্তা না ধরে পেছনের সরু নুড়িপথটা ধরত। ধরণী স্যার সামনের রাস্তার ওপর বেত হাতে তে! তে! থাকতেন -- কখন ছোঁড়াগুলো ফেরে। আর ওরা পেছনের রাস্তা দিয়ে ফিরে চুপচাপ ভালো ছেলেটির মতো পাঠশালায় মাদুর বিছিয়ে বসে থাকত। স্যার জিজ্ঞেস করলে এমন ভাব করত যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। ডানহাতের কনে আঙুলটা ওপরের দিকে উঠিয়ে বলত, ‘ইয়ে করতে গেছিলাম স্যার। কিন্তু কুলের গন্ধ সামাল দেওয়া খুব কষ্টকর, তবু প্রাণান্তকর চেষ্টায় পঞ্চু-বীরু-তপুদের মুখে কুলের গন্ধের উৎস হয়ে যেত বুচুদের বাড়ির গাছ, বা বীরুদের বাড়ির গাছ অথবা আর কোনো নাম না জানা বন্ধুর কাকা-দাদা বা জ্যাঠাদের বাড়ির কুল। কিন্তু সবদিন ওদের, একদিন ধরণী মাস্টারের। তিনি জানতেন, ছোঁড়াগুলো পেছনের নুড়িপথ দিয়েই যাওয়া-আসা করে। একদিন ধরে ফেললেন ঠিক, ‘ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে আদারে-বাদারে ঘুইরে বেড়ানো আর ভুতের গাছের কুল খাওয়া তোদের বার করতিছি দাঁড়া। -- ওঃ সে কী মার! বেতের লালচে দাগ বসে গিয়েছিল হাতে আর পিঠে। গোঁসানির মাঠে বসে চুরি করে আনা কারো বাগানের জলপাই বা পেয়ারা খেতে খেতে সেসব মজার গল্প বুচু ওরফে কৌশিককে শোনাত বীরু। প্রায়ই অনুনয় করে বলত, ‘বুচু, তোরা চলে আয় না এখানে। রোজ কত মজা হবে। তারপর আমরা নাহয় ম্যা¿ট্রক পাশ করে তোদের ওখানকার স্কুলে গিয়ে ভর্তি হব। রোজ রোজ এখানে খেলব, কুল পাড়ব আরও নানা রকম মজা করব সবাই মিলে।
                             কৌশিকের ইচ্ছে থাকলেও বাবার চাকরির জন্য গ্রামে পাকাপাকি ভাবে এসে থাকাটা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ওই নুড়িরাস্তার পাশে বাঁশঝাড়টাও গ্রামে ওদের মামাবাড়িতে না-থাকার একটা কারণ। গরমের ছুটি, পুজোর ছুটি বা অন্য যেকোনো ছুটিছাটায় কৌশিক মা-বাবার সঙ্গে মামাবাড়ি চলে আসবে -- এটা সবাই জানত। তার অবশ্য বেশি ভালো লাগত পুজোর ছুটিতে। লক্ষ্মীপুজোর পর স্কুল খুলে গেলেও কালিপুজো পর্যন্ত তেমন পড়াশোনার চাপ নেই। তাই একটু বেশিদিন গ্রামে বন্ধুদের সঙ্গে দিন কাটাতে পারে। তেমনই একবার মামাবাড়িতে ভাইবোনদের সঙ্গে সে থেকে গিয়েছিল। সে-কদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি বীরু-পঞ্চুদের দলটার সঙ্গে একেবারে টইটই, মামাদের শাসন-টাসন মানার তখন আর কোনো বালাই নেই। কালিপুজোর দিন চুটিয়ে বাজি পোড়ানোর প্ল্যানটা তখনই হয়েছিল।
                             বীরু চারচারটে হাউইবাজি মুঠো করে বেঁধে পঞ্চুর নতুন খোঁড়া গর্তে দাঁড় করিয়ে দিল -- সেগুলো একটু হেলে গিয়ে কুলগাছের ওপর দিয়ে উড়ে যাবার জন্য তৈরি। এবার পাপন একটা চেকন বাঁশের কঞ্চির মাথাটা সামান্য চিরে তার মধ্যে জ্বলন্ত মোমের টুকরো সেঁধিয়ে নিয়ে হাউইয়ের সলতেয় আগুন দেবার জন্য তৈরি। তার হাত কাঁপছিল। পঞ্চু কঞ্চিসমেত পাপনের হাত চেপে ধরল আর দুজনে মিলে হাউইবাজির সলতেগুলোতে জ্বলন্ত মোমটা লাগিয়ে দিল। ব্যস্, একটা তীব্র আলোর ঝলকানির সঙ্গে সরসর শব্দে হাউইগুলো গর্ত ছেড়ে ছুটে বেরোল। আর তারপরই ঘটল অঘটন। বুম্ম্ শব্দে একটা হাউই ফেটে গিয়ে সামনেই মুখ থুবড়ে পড়ল, একটা সোঁওও করে বাঁদিকে কাত হয়ে কুলগাছের গায়ে গোঁত্তা মেরে ফুসস্ হয়ে গেল। বাকি দুটো বাঁশঝাড়ে মধ্যে আছড়ে পড়ল ঢেউয়ের মতো এলোমেলো ছুটতে ছুটতে আর বিকট শব্দে ফেটে গেল। সবার চোখ এড়িয়ে বীরু দুটো চকোলেট বোমও হাউইগুলোর সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিল -- তাই শব্দটা বেশ জোরে হল। বাঁশঝাড়ের গোড়ায় বোধহয় শুকনো পাতা জমা হয়ে ছিল -- আগুন লেগে গেল সেখানে। ধিকিধিকি আগুন বাড়তে লাগল। ওপরের দিকেও হাউইয়ের জ্বলন্ত কাঠিতে লেগে বাঁশের পাতা জ্বলছিল মিহিমিহি।
                             এবার বীরের দলের হুঁশ ফিরল। চারদিকের অন্ধকার ভেদ করে একটু দূরের ওই আগুন কেমন যেন ক্রমে ওপর থেকে লকলকে জিভ বার করে ওদের দিকে ধেয়ে আসতে লাগল। পঞ্চু ‘ভুত ‘ভুত বলে চিৎকার করে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে দে-ছুট। বীরু-পাপনও তাই। কৌশিকের পা যেন মাটিতে আটকে গিয়েছিল, চাইলেও তার পা নড়ছিল না। চারদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, আঁচি-লণ্ঠনগুলো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে লালপাড় শাড়ি পরে কে যেন হাত বাড়িয়ে তাকে জাপটে ধরতে আসছে -- সে পিছন ফিরে দৌড়তে পারছে না। চোখ তার ছানাবড়া, দেখছে সেই ভীষণ মূর্তিকে -- কালো রাক্ষসীর মতো দেখতে মূর্তিটি আরও কাছে আসছে, আরও, আরও........
                             বীরু তার জামার কলার ধরে হ্যাঁচকা টান না মারলে সে বোধহয় ওখানেই স্ট্যাচুহয়ে যেত, ‘এ্যাই বুচু, দৌড়ো....।
                             হাঁফাতে হাঁফাতে তারা সে-রাতে যে-যার বাড়ি ফিরে গিয়েছিল -- কারণ এরপর তাদের আর বাজি পোড়ানোর খেলাটা জমেনি। কিন্তু কৌশিকের সারা শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল সে-রাতে, সঙ্গে ভুলভাল বকা। ভোরবেলা গ্রামের হোমিও ডাক্তার শশীবাবু গম্ভীরভাবে তার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘তড়কা জ্বর, কোনো কিছুতে ভয় পেইয়েছে, চিন্তার কারণ নেইকো। অ্যাকোনাইট দিইছি, তাড়াতাড়ি সেইরে যাবে। রেতের বেলা একা একা পেছনের ছোটো কলঘরে যাতে দেবেননি। আর ....’ কৌশিকের দিকে গোঁফজোড়া মুখ বাড়িয়ে বলেছিলেন ‘গোঁসানির মাঠে দিনে দিনেই খেলা ভালো খোকা, আর বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় যেওনি যেন।
                             সেবার সেরে উঠতে বেশ কিছুদিন লেগে গিয়েছিল। বীরুদের দলটাকে তখন কদিন দত্তবাড়ির ত্রিসীমানায় দেখা যায়নি। ওদের বাজি পোড়ানোর খবরটা বেশ রসিয়েই গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাই সবার বাড়ির খড়ম-ছাতার ডাঁটি- ভাঙা স্কেল ইত্যাদির উপযুক্ত ব্যবহার হয়েছিল পিঠের ওপর। শুধু জ্বরে কাহিল বলে কৌশিক সে-যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল।
                             তিন
                             বৃষ্টিটা বেশ জাঁকিয়েই নেমেছে। চারদিক কালো মেঘে ঢাকা। রেললাইনের ওপরটায় ছাইরঙা মেঘ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বিকেলের প্যাসেঞ্জার Îট্রনটা এইমাত্র লাইনে খটাক্ খটাক্ শব্দ তুলে চলে গেল, তার লালরঙা কামরাগুলো মাঠের এদিক থেকে কালো কালো মনে হচ্ছে। ওপারের বাড়িঘরগুলো আর দেখা যােচ্ছ না। সন্ধ্যে না হলেও মাঠের চারধারে অন্ধকার নেমেই গেছে। মাঠময় ছুটতে ছুটতে কৌশিক-বীরু-তপুরা কখন যে নুড়িরাস্তায় চলে এসেছে, বুঝতে পারেনি। প্রথমে কে কাকে ছুঁতে পারে আর তারপর গাছের আড়ালে আবডালে তাদের লুকোচুরি খেলা বেশ জমেই উঠেছিল। কৌশিক জানে, বৃষ্টিতে ভেজার জন্য আজকে মা-ঠাম্মার বকুনি খেতেই হবে। জ্বরও আসতে পারে। আসুক, কুছপরোয়া নেই। এমন মজার খেলা সে কি আর ঘরের ভেতর বসে বসে খেলতে পারত! এতক্ষণ যে একবারও সে হাঁচেনি বা তার শীতশীত ভাবটাও যে চলে গেছে -- এটা মনে করে কৌশিকের খুব ভালোই লাগছে। কানমলা বা দু-চার ঘা-কিল খাবার ভয়টাও চলে গেছে। এবার আর শশীমাস্টারের অ্যাকোনাইট কি রাসটকস্ খেতে হবে না।
                             খেলতে খেলতে কৌশিক বাঁশঝাড়ের ভেতর একটা ভালো জায়গা খুঁজে পেয়েছে। এখান থেকে চারপাশটা ভালো দেখা যায়, আর কেউ যদি পেছনের দিকে যাবার চেষ্টা করে সেটাও নজরে পড়বে। তপু-পাপনরা হন্যে হয়ে খুঁজছে। বীরুও নিশ্চয়ই একটা ভালো জায়গা দেখে লুকিয়ে আছে। দু-একবার এরা বাঁশঝাড়ের সামনে ঘোরাঘুরি করে গেল। আঃ কী মজা! এবার আর ওরা তাকে হারাতে পারবে না।
                             একবার কুলগাছের ওদিক থেকে তপুর গলা ভেসে এল, ‘বুচুউউউ..... অ্যাই বুচুউউউ...... বীরু,..... বীরু-উ-উ-উ-উ......। তারপর আর কোনো আওয়াজ নেই।  কৌশিক এবার তপু-পাপনকে দেখতে পেল বাঁশঝাড়ের সামনে এসে দাঁড়াতে। দুজনেই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। পাপন তার নাম ধরে ডাকল, ‘বুচু..উ-উ-উ, বুচুরে-এএএ। বাঁশঝাড়ের ভেতরে থাকলে বেরিয়ে আয়। ...... বীরুউউউউ, কোথায় গেলি তোরা....।
                             -- বাঃ, ওরা এখনও তাকে আর বীরুকে খুঁজে পায়নি! খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে লুকিয়ে থাকতেই হবে -- বীরুকে জিততে দেওয়া চলবে না। কিন্তু বীরু কোথায়!  সে আবার কুলগাছের জঙ্গলটায় গিয়ে লুকোল না তো! একচালাগুলোর পেছনে একটা ছোটো খড়ের গাদা আছে -- কি জানি, ওখানেও লুকোতে পারে! তবে ওখানে থাকলে এতক্ষণে তপুরা ওকে বার করে ফেলত। মরুক গে যা, সে বেরোচ্ছে না এই জায়গাটা ছেড়ে। স্কুলে ফার্স্ট হোক না হোক, যতই মা-র বকুনি খাক, আজকের খেলায় কেউ তাকে খুঁজে বার করতে পারবে না -- যতই ‘বেরিয়ে আয় ‘বেরিয়ে আয় বলে হাঁক পাড়ো বাবা -- যতক্ষণ না ওরা সবগুলো মিলে হার স্বীকার করছে, ততক্ষণ সে এখান থেকে বেরোবে না।
                             ওদের ডাক আবার কৌশিকের কানে গেল -- এবার সামনে নয়, তার ডানপাশ থেকে আওয়াজটা ভেসে এল, ‘বুচু..... কথা শোন, ভালোয় ভালোয় বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আয়, সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে কিন্তু....।
                             ‘বাঁশঝাড় আর ‘সন্ধ্যে শব্দদুটো এবার কৌশিকের কানে হুলের মতো বিঁধল -- বুকের মাঝখানটায় কেমন যেন করে উঠল। ঘাড়ের কাছে কার যেন গরম নিশ্বাসও পড়ল। গায়ে কাঁটা দিল তার। তবু একবার ভাবল, এটা বীরুর চাল নয়ত! হয়ত পঞ্চুদের শিখিয়ে দিয়েছে এভাবে বলতে! কিন্তু, সে তো সত্যিই বাঁশঝাড়ের ভেতর বসে আছে! এতক্ষণ খেয়াল করেনি, লুকোবার ভালো জায়গা খুঁজতে খুঁজতে এ-জায়গাটাতে এসে চুপটি করে বসে ছিল। এখন একটু শীত শীতও করছে -- তার আশপাশের বাতাসটাও কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা, একটা খসখস আওয়াজও যেন শোনা যাচ্ছে। আবার হাল্কা গরম হাওয়াও তার ঘাড়ের কাছে সিরসির করছে মনে হল। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে যাবে, ঠিক তখনই একটা সাদা লালপাড় কাপড়ে জড়ানো চারা বাঁশগাছ নুয়ে পড়ে তার কানের কাছে নাকি সুরে বলল, ‘বুঁচুঁ-উঁ-উঁ.... এঁবাঁর তোঁকেঁ খাঁবোঁ-ওঁ-ওঁ....।
                             তপু-পাপনরা তখন কাদামাঠে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে কি না, তা আর দেখা হয়নি কৌশিকের। সে তখন কাদামাঠে চোখ উল্টে কালি গোঁসানির সঙ্গে কসমস বল দিয়ে ফুটবল খেলছিল।
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ

Tuesday, 16 June 2020

আটপৌরে কথাগুলো


আটপৌরে
--জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত

ফাইটার 
        '... উঠুম না...'
মাস্ক পরে যে দু-চারজন দরদাম করছিল, তারা এখন হাত তিনেক দূরের বৃত্তে দাঁড়িয়ে রঙ দেখছে। দীপুর বুকে ধুকপুকুনি। সত্যিই, গ্রিনউড লেনের মুখটাতে বসে পড়াটা উচিত হয়নি।
        সচেতন নাগরিকেরা অফিসে বেরোচ্ছেন -- আর রাস্তার মুখটাতেই কি না জ্যাম!! গলার শিরা ফোলানো দমে বসাক জুয়েলার্সের সোনারূপোর 'বার'গুলো যেভাবে ব্লোয়ারের গোড়ায় টলমল করত, বগা মাছওয়ালাও সেদিন টালমাটাল পায়ে সরে পড়েছিল। আর আজ !!
       'তুমি তালুকদারের বাড়িতে ভাড়া থাকো না ! বসাকের দোকানে তো কাজ করো! পাড়ার ছেলে হয়ে এইসব ! একটা সিভিক সেন্স নেই!! এটা কি লকডাউনের বাজার!!?? লাথি মেরে উড়িয়ে দেবো সব।' ...
       এরকম একটা ব্লোয়ারের আগুন থেকে মাছের গামলাটা বাঁচাতে মাথা নোয়ায় দীপু -- চোখে ভেসে ওঠে বড়ো আদরের দুজোড়া উপোসী মুখ আর সাইকেলে মাছের হাঁড়ি চাপিয়ে হাত দশেক দূরে অপেক্ষারত সাপ্লায়ার বগা -- বুকের ড্রামবিটের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কানে বাজে 'ফাইট, দীপু ফাইট'।

শিপ্রা নদীতীরে
        ভেজানো দরজাটা খোলার পর.........
        ...... সিনেমায় যেমন হয়, শিপ্রা বেরিয়ে এলো। পরনে একটা আগুন রঙের ফ্রক। নিচে তাকালে হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, ধবধবে ফরসা। ওপরে তাকালে ঘাড়ের পেছনে দুটো বেণি, তার সামনে কানের লতিতে ছোট্ট সোনার দুল দুলছে, মিস্টি হাসি দুটো রাঙানো ঠোঁটে ঝুলছে, চোখে দুষ্টুমি, ভ্রূ ধনুকের মতো – এর বেশি আর চোখ সায় দিচ্ছে না। গালে একটু টোল পড়ল, যখন প্রায় ফিসফিসিয়ে বললাম ‘পরীক্ষার রুটিনটা নিয়ে এসেছি’
--‘ভেতরে এসো’একটা সুন্দর নরম হাত এগিয়ে এলো। বাহুমূলে শিহরণ, নরম ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল বুকটাও। মনে হল স্বর্গ নেমে আসছে, বেজে উঠেছে জলতরঙ্গ – ‘মা দ্যাখো, রাহুল এসেছে’।
        শিপ্রার মায়ের এন্ট্রিটা এখন ঠিক পোষাবে না, ওর এইভাবে আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে থাকা আর ওর গায়ে ল্যাপ্টানো মিস্টি গন্ধটা দূরে সরে যাক তা চাইছি না। এরকম সান্নিধ্যের জন্য আমি হাজার বার শিপ্রার কাছে আসতে পারি।
পকেট থেকে ভাঁজ করা নতুন রুটিন বার করতেই সে বাঁহাতে ছোঁ মেরে নিল আদুরে ভঙ্গিতেওর কড়ে আঙুলের হাল্কা গোলাপি নেলপালিশ লাগানো বড় নখটা আমার হাতের তালুতে আলতো সুড়সুড়ি দিল। রুটিনটায় একবার আয়ত চোখের আদরে বুলিয়ে শিপ্রা বাঁকা ধনুকের ছিলায় তির রেখে জানতে চাইল, ‘রুটিনটা ঠিকঠাক আছে তো? আবার ভুলভাল এনে দাওনি তো  পরীক্ষায় আমাকে ডাউন দেবার জন্য?’......
ভেজানো দরজার গায়ে সেঁটে আছেন শিপ্রার মা, ওঁর বাড়ানো হাতে গোঁজা রুটিন।
ভুসি-ভুনি-ভুডি
      এ-পাড়ায় সেএইমাত্র এসেছে। একেবারে ঘুরঘুটটি অন্ধকার। অমাবস্যা নাকি লোডশেডিং! মাথা গোঁজার ঠাই হবে তো!একা একা থাকবে কীভাবে আর থাকবেটাই বা কোথায়!! হঠাৎ ছপ ছপ শব্দ--অন্ধকারএখন অনেকটা সয়ে এসেছে।আরে এখানে যে একটা খাল আছে তাতো খেয়াল হয়নি! ফুরফুরে মাঠের বাতাসও আছে! এই অন্ধকারে জলের ধারে কে কী করছে দেখার জন্য সে একটু হেলে গেল। হাঁটু জলে গামছা পরে কে যেন মাছ ধরছে!! 'কে ওখানে?' ---হাঁক পাড়ে সে।নিজের অজান্তেই গলাটা তার কেমন যেন খ্যানখেনিয়ে উড়ে গেল। তার গলা পেয়ে অপরজন ঘাড় বেঁকিয়ে আকর্ণ হাসল। আরে এ তো মেছুনি! অন্ধকারেও মনে হচ্ছে 'বিউটিফুল'অজান্তেই মনে হয় তার খ্যানখেনে গলায় বেরিয়ে এল 'I love you.' মেছুনিও মাছের ঝুড়ি কোমরে দুলিয়ে তার কাছে এগিয়ে এলো।হাড্ডিসার চেহারা। তবু ভালো লেগে গেল। সে এসে তার হাত ধরল। একেবারে সাঁড়াশির মতো আঙুল---বরফের মতো সাদা হলেও একটা উষ্ণতার ছোঁয়া পেল। অন্ধকারটাও তখন তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। মেছুনি জানতে চাইল 'আজই এলে?' --- ইসস কি মিস্টি আওয়াজ! মনে হচ্ছে কতদূর থেকে এই খোলা মাঠে ভেসে আসছে! উত্তর দিল,'হ্যাঁ,এই তো একটু আগে। ওই যখন কানা ট্রাকটা দড়াম করে....' মেছুনি তার ভাঙা দাঁতের গোড়ায় সরু সাদা আঙুলগুলো ঢুকিয়ে দিল মানে ঢুকে গেল আর কি! তার আর কিছু বলা হলো না। মেছুনি বললো, ‘শ্যাওড়া বনের  ওধারটায় একটা নতুন বেলগাছ আছে, তোমার তো পৈতে দেখছি গলায় --- আমিও গেছো বামনি বাপ-মা জোর করে একটা মদারুর গলায় ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। ফেন্সিডিল সাঁটিয়ে চলে এসেছি। আসা ইস্তক এ পাড়ায় তেমন কাউকে চোখে পড়েনি। চলো এবার জীবনটা ওখানে বসেই দুজনে কাটিয়ে দেবো। আর তো কোথাও যাওয়া নেই। কি বলো?’....

আমোরেমিঅ
               সাগরের ঢেউগুলো যদিও চেনা, এমনকি বালুতটে একের পর এক তাদের সরে যাওয়ার সফেন চিহ্নগুলোও --- তবু প্রত্যেকটা ঢেউ, বেলাভূমির পটে আঁকাবাঁকা মানচিত্র, প্রতিদিন নতুন হয়ে ওঠে মেরি ডি-কোস্টার আয়ত  চোখের পর্দায়। ঢেউকে ভালোবেসে সে গান গায়..... না না চার্চ বা পার্টিতে নয় -- আগে গাইত মায়ের সঙ্গে, মা চলে যাবার পর  একা একাই, বসার ঘরে পিয়ানোর সামনে বসে। দক্ষিণের দেওয়াল জোড়া জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যেত,...... যাচ্ছে এখনও।
    এখানে বসেই কতদিন  অমিতাভের হাতে হাত রেখে সে জিনাত  আমনের মতো গান গেয়েছে, 'দো লবজোঁ কি হ্যায়......' ---- ভেসে গিয়েছে সাগরের ঢেউয়ে ভর করে। তার কিশোরীবেলায় জন ডি-কোস্টাও সব ছেড়েছুড়ে কোথায় যেন ভেসে গিয়েছিলেন! তারপর থেকে মা  এরকমই আনমনা সিঁদুরে বিকেলগুলোতে কখনও কখনও তাকে পাশে বসিয়ে একটা গান শোনাতেন, .....টেগোরের।
       আজ, এই মুহূর্তে জানালা দিয়ে সাগরের  উচ্ছলতা দেখতে দেখতে মায়ের সেই গানটা পিয়ানোতে বাজাতে ইচ্ছে করছে মেরির, -- 'ও মোর দরদিয়া ......'

জানালায় কে
আরেকটা ব্যস্ত সকালের প্রস্তুতি নিতে নিতেই রাত ঘনিয়ে আসে। আমিষাশী প্রহরগুলো তিনতলার ব্যবহৃত জানালাগুলোতে ঠায় দাঁড়িয়ে। তবু অন্ধকার ডুব দেবার আগেই সে ফেলে আসা মুহূর্তগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করে। এক চিলতে ঘরের বিরক্তিকর আলোগুলো নিভিয়ে ছোট্ট খোলা জানালার কাঁচের ওপারে সমস্ত শ্রান্তিকে ঢেলে দেয়। তার শরীর বেয়ে তখন বৃষ্টি নামে, হাতছানি দেয় দূরের আকাশ......
হাতের মোবাইলটা কেঁপে উঠল। দেখল শ্যামলী, চিকন গৌর মুখখানি তার ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। -- ‘কি করছ দোলনদি?’
উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না। একগাদা পিএনপিসি ছাড়া আর কিছুই হবে না।
--‘উনি তো তোমার দরদীয়া গানটার খুব প্রশংসা করলেন। বললেন, তোমার গলায় একটা অদ্ভুত স্যাডনেস আছে। অথচ এতটা হাসিখুসি!’
সবুজ আলোটা জ্বলুক... কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একটা তারা জ্বলে উঠল। অন্ধকারে মৃত আলো ছড়িয়ে পড়ল কোন জানালায়??!!

প্রিয়তমার নতুন চিঠি
 যেদিন তোমার আসার সময় হবে সেদিন পাখিরা-গাছেরা আর রঙেরা চিনিয়ে দেবে পথ। তোমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে আসতে এগিয়ে যাব আমি। মনে পড়ে, এর আগের চিঠিতে এমনটাই লিখেছিলাম? নদীর স্রোত বেয়ে সেই চিঠি হয়তো বা গিয়েছিল তোমার দেশে, অনন্ত অপেক্ষার শেষে। হয়তো.....।
না লেখা চিঠির পোড়া  কালো অক্ষরে ডুব দিয়ে আর বার করব না কোনো স্বপ্নাতুর তারার আকাশ। যদি আসো, তবে দেখা দেবে পুরনো হৃদয়, তাকে ছুঁয়ে চলে যাবো ব্যস্ততম পিচঢালা পথে। আর দেখবো না ছায়ার মতন তোমাকেও।

গ্যাস বেলুন
        এই পৃথিবীতে কেউ চিরদিনের জন্য আসেনি – তুমিও না আমিও না, কিন্তু আমাদের দুজনার ভেতর যে আছে, তার আসা-যাওয়ায় তোমার কোন হাত নেই – তাকে তুমি ডেকে আনতে পারো না, ধরে রাখতেও নয় – আর ছেড়ে দেওয়া বা ছুঁড়ে ফেলা? – হাঃ, কোনোটাই তোমাকে দিয়ে হবে না, .... আমাকে দিয়েও না – তবু আমাকে নাগালে পেলেই সুতোয় বেঁধে রাখতে চাও, নাড়াচারা করতে চাও নিজের খুশিতে – মনের মতো করে, চটকে আদর করো, আবার যখনতখন যেখানে সেখানে গিঁটও মারো – আর যখন এই নাগাল ছাড়িয়ে উড়ে যাই আকাশের দিকে, তখন তাকিয়ে থাকো অবাক হয়ে, কখনও বা মুগ্ধ দৃষ্টিতে....।
        ইসসস্ .... তোমার ওই দৃষ্টিটা যদি আগেও থাকত,.... তবে দুজনে মিলেই আকাশে ভাসতাম।
কী মজা হতো, তাই না !! ....
        স্ক্রীনে দুটি মুখ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে, থেমে যাবার আগে রাতভর আঙুল চালায় কিবোর্ডে।
----------------------------

ভূমিকম্প
        ২৯ তারিখ। সুজন, দীপামণি, বোড়োদা বা বৈশ্যর মতো আরো অনেকের সঙ্গে তারা তখন নোটার বোতামটা টিপে দিয়ে বুথ থেকে বেরিয়ে আসছে আর হারিয়ে যাচ্ছে ভিড়ের ভেতর।
১৭ তারিখ। রঙিন ধ্বসে যাওয়া ঘরবাড়িগুলোর চারদিকে যেন হলুদ ফিতের ঘের। ফিতের গায়ে সার দিয়ে অন্ধকারেও জ্বলছে physically unsafe শব্দ দুটো।   
দুটো ছায়ামানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতিউতি-- চলাফেরায় সংশয় আর প্রত্যাশা। একজন অন্য জনের কাছে ভাঙাচোরা গলায় জানতে চাইল, 'বাইচ্যা আসে নিকি কেউ?' অন্ধকারে উত্তর ভেসে এলো--'কান খাড়া রাইখো, গুমরানির আওয়াজ পাইতে পারো।'
--'কাছে কাছেই থাইকো বাই।'
--'তখন থিকাই তো আছি, চিন্তা কোইরো না।'
--'কিন্তু গুমরানির আওয়াজ পাইলেই বা কি, কিছুই তো করার নাই।'
--'কেন? দুইহাতে ইট-পাথরের জঞ্জাল সরাইয়া পরাণডা বাচাইতে ত পারবা!'
--'একলা হাতে পারুম ক্যামনে এইসব!'
--'হা হা হা।  আমার হাত দুইটা আছে কী করতে বন্ধু!'
--'তোমার ওই হাত...!' অন্ধকারেও ছায়ামানুষটির গলা কাঁপল অবিশ্বাসে।
--'কেন! আমরা দুইজনে মিল্যা কি ইঁটের ধামা তুইল্যা নিসি না? মাখা মশলার কড়াইগুলা হাতে হাতে কালুমিস্ত্রির ছেনির পাশে থুইয়া আই নাই? আমার খাউড়া বিড়িখান হাত বাড়াইয়া লও নাই?'
--', হেইগুলি ত করসি। এক মালিকের আণ্ডারে একলগে থাকলে হইবই। তবু....।'
 দ্বিতীয়জনের মুখে করুণ হাসি খেলে গেল।
১৬ তারিখ। হৃৎস্পন্দন এখনও কান পাতলে শোনা যাবে, এতটাই ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে ভূমিকম্পে।
                                             -------------