আটপৌরে
--জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত
ফাইটার
'... উঠুম না...'মাস্ক পরে যে দু-চারজন দরদাম করছিল, তারা এখন হাত তিনেক দূরের বৃত্তে দাঁড়িয়ে রঙ দেখছে। দীপুর বুকে ধুকপুকুনি। সত্যিই, গ্রিনউড লেনের মুখটাতে বসে পড়াটা উচিত হয়নি।
সচেতন নাগরিকেরা অফিসে বেরোচ্ছেন -- আর রাস্তার মুখটাতেই কি না জ্যাম!! গলার শিরা ফোলানো দমে বসাক জুয়েলার্সের সোনারূপোর 'বার'গুলো যেভাবে ব্লোয়ারের গোড়ায় টলমল করত, বগা মাছওয়ালাও সেদিন টালমাটাল পায়ে সরে পড়েছিল। আর আজ !!
'তুমি তালুকদারের বাড়িতে ভাড়া থাকো না ! বসাকের দোকানে তো কাজ করো! পাড়ার ছেলে হয়ে এইসব ! একটা সিভিক সেন্স নেই!! এটা কি লকডাউনের বাজার!!?? লাথি মেরে উড়িয়ে দেবো সব।' ...
এরকম একটা ব্লোয়ারের আগুন থেকে মাছের গামলাটা বাঁচাতে মাথা নোয়ায় দীপু -- চোখে ভেসে ওঠে বড়ো আদরের দুজোড়া উপোসী মুখ আর সাইকেলে মাছের হাঁড়ি চাপিয়ে হাত দশেক দূরে অপেক্ষারত সাপ্লায়ার বগা -- বুকের ড্রামবিটের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কানে বাজে 'ফাইট, দীপু ফাইট'।
শিপ্রা নদীতীরে
ভেজানো দরজাটা খোলার পর.........
...... সিনেমায় যেমন হয়, শিপ্রা বেরিয়ে
এলো। পরনে একটা আগুন রঙের ফ্রক। নিচে তাকালে হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত দেখা
যাচ্ছে, ধবধবে ফরসা। ওপরে তাকালে ঘাড়ের পেছনে দুটো বেণি, তার সামনে কানের লতিতে
ছোট্ট সোনার দুল দুলছে, মিস্টি হাসি দুটো রাঙানো ঠোঁটে ঝুলছে, চোখে দুষ্টুমি, ভ্রূ
ধনুকের মতো – এর বেশি আর চোখ সায় দিচ্ছে না। গালে একটু টোল পড়ল, যখন প্রায়
ফিসফিসিয়ে বললাম ‘পরীক্ষার রুটিনটা নিয়ে এসেছি’।
--‘ভেতরে এসো’। একটা
সুন্দর নরম হাত এগিয়ে এলো। বাহুমূলে শিহরণ, নরম ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল বুকটাও।
মনে হল স্বর্গ নেমে আসছে, বেজে উঠেছে জলতরঙ্গ – ‘মা দ্যাখো, রাহুল এসেছে’।
শিপ্রার মায়ের এন্ট্রিটা এখন ঠিক পোষাবে
না, ওর এইভাবে আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে থাকা আর ওর গায়ে ল্যাপ্টানো মিস্টি গন্ধটা
দূরে সরে যাক তা চাইছি না। এরকম সান্নিধ্যের জন্য আমি হাজার বার শিপ্রার কাছে আসতে
পারি।
পকেট থেকে ভাঁজ করা
নতুন রুটিন বার করতেই সে বাঁহাতে ছোঁ মেরে নিল আদুরে ভঙ্গিতে। ওর
কড়ে আঙুলের হাল্কা গোলাপি নেলপালিশ লাগানো বড় নখটা আমার হাতের তালুতে আলতো সুড়সুড়ি
দিল। রুটিনটায় একবার আয়ত চোখের আদরে বুলিয়ে শিপ্রা বাঁকা ধনুকের ছিলায় তির রেখে
জানতে চাইল, ‘রুটিনটা ঠিকঠাক আছে তো? আবার ভুলভাল এনে দাওনি তো পরীক্ষায় আমাকে ডাউন দেবার জন্য?’......
ভেজানো দরজার গায়ে সেঁটে আছেন শিপ্রার মা, ওঁর বাড়ানো হাতে
গোঁজা রুটিন।
ভুসি-ভুনি-ভুডি
এ-পাড়ায় সেএইমাত্র এসেছে। একেবারে ঘুরঘুটটি
অন্ধকার। অমাবস্যা নাকি লোডশেডিং! মাথা গোঁজার ঠাই হবে তো!একা একা থাকবে কীভাবে আর
থাকবেটাই বা কোথায়!! হঠাৎ ছপ ছপ শব্দ--অন্ধকারএখন অনেকটা সয়ে এসেছে।আরে এখানে যে
একটা খাল আছে তাতো খেয়াল হয়নি! ফুরফুরে মাঠের বাতাসও আছে! এই অন্ধকারে জলের ধারে
কে কী করছে দেখার জন্য সে একটু হেলে গেল। হাঁটু জলে গামছা পরে কে যেন মাছ ধরছে!! 'কে ওখানে?'
---হাঁক পাড়ে সে।নিজের অজান্তেই গলাটা তার কেমন যেন খ্যানখেনিয়ে
উড়ে গেল। তার গলা পেয়ে অপরজন ঘাড় বেঁকিয়ে আকর্ণ হাসল। আরে এ তো মেছুনি! অন্ধকারেও
মনে হচ্ছে 'বিউটিফুল'। অজান্তেই মনে হয় তার
খ্যানখেনে গলায় বেরিয়ে এল 'I
love you.' মেছুনিও মাছের ঝুড়ি কোমরে দুলিয়ে তার কাছে এগিয়ে
এলো।হাড্ডিসার চেহারা। তবু ভালো লেগে গেল। সে এসে তার হাত ধরল। একেবারে সাঁড়াশির
মতো আঙুল---বরফের মতো সাদা হলেও একটা উষ্ণতার ছোঁয়া পেল। অন্ধকারটাও তখন তার ভালো
লাগতে শুরু করেছে। মেছুনি জানতে চাইল 'আজই এলে?'
--- ইসস কি মিস্টি আওয়াজ! মনে হচ্ছে কতদূর থেকে এই খোলা মাঠে
ভেসে আসছে! উত্তর দিল,'হ্যাঁ,এই
তো একটু আগে। ওই যখন কানা ট্রাকটা দড়াম করে....।' মেছুনি তার
ভাঙা দাঁতের গোড়ায় সরু সাদা আঙুলগুলো ঢুকিয়ে দিল মানে ঢুকে গেল আর কি! তার আর কিছু
বলা হলো না। মেছুনি বললো, ‘শ্যাওড়া বনের ওধারটায় একটা নতুন বেলগাছ আছে, তোমার তো পৈতে দেখছি গলায় --- আমিও গেছো বামনি। বাপ-মা জোর করে একটা
মদারুর গলায় ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। ফেন্সিডিল সাঁটিয়ে চলে এসেছি। আসা ইস্তক এ পাড়ায়
তেমন কাউকে চোখে পড়েনি। চলো এবার জীবনটা ওখানে বসেই দুজনে কাটিয়ে দেবো। আর তো
কোথাও যাওয়া নেই। কি বলো?’....
আমোরেমিঅ
সাগরের ঢেউগুলো যদিও চেনা, এমনকি বালুতটে একের পর এক তাদের সরে যাওয়ার সফেন চিহ্নগুলোও --- তবু
প্রত্যেকটা ঢেউ, বেলাভূমির পটে আঁকাবাঁকা মানচিত্র,
প্রতিদিন নতুন হয়ে ওঠে মেরি ডি-কোস্টার আয়ত চোখের পর্দায়। ঢেউকে ভালোবেসে সে গান গায়.....
না না চার্চ বা পার্টিতে নয় -- আগে গাইত মায়ের সঙ্গে, মা
চলে যাবার পর একা একাই, বসার ঘরে পিয়ানোর সামনে বসে। দক্ষিণের দেওয়াল জোড়া জানালা দিয়ে সমুদ্র
দেখা যেত,...... যাচ্ছে এখনও।
এখানে বসেই কতদিন অমিতাভের হাতে হাত রেখে সে জিনাত আমনের মতো গান গেয়েছে, 'দো লবজোঁ কি
হ্যায়......' ---- ভেসে গিয়েছে সাগরের ঢেউয়ে ভর করে। তার
কিশোরীবেলায় জন ডি-কোস্টাও সব ছেড়েছুড়ে কোথায় যেন ভেসে গিয়েছিলেন! তারপর থেকে
মা এরকমই আনমনা সিঁদুরে বিকেলগুলোতে কখনও
কখনও তাকে পাশে বসিয়ে একটা গান শোনাতেন, .....টেগোরের।
আজ, এই মুহূর্তে জানালা দিয়ে সাগরের উচ্ছলতা দেখতে দেখতে মায়ের সেই গানটা পিয়ানোতে
বাজাতে ইচ্ছে করছে মেরির, -- 'ও মোর দরদিয়া ......'
জানালায় কে
আরেকটা ব্যস্ত সকালের
প্রস্তুতি নিতে নিতেই রাত ঘনিয়ে আসে। আমিষাশী প্রহরগুলো তিনতলার ব্যবহৃত
জানালাগুলোতে ঠায় দাঁড়িয়ে। তবু অন্ধকার ডুব দেবার আগেই সে ফেলে আসা মুহূর্তগুলোর
পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করে। এক চিলতে ঘরের বিরক্তিকর আলোগুলো নিভিয়ে
ছোট্ট খোলা জানালার কাঁচের ওপারে সমস্ত শ্রান্তিকে ঢেলে দেয়। তার শরীর বেয়ে তখন
বৃষ্টি নামে, হাতছানি দেয় দূরের আকাশ......
হাতের মোবাইলটা কেঁপে
উঠল। দেখল শ্যামলী, চিকন গৌর মুখখানি তার ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। -- ‘কি করছ
দোলনদি?’
উত্তর দিতে ইচ্ছে করল
না। একগাদা পিএনপিসি ছাড়া আর কিছুই হবে না।
--‘উনি তো তোমার
দরদীয়া গানটার খুব প্রশংসা করলেন। বললেন, তোমার গলায় একটা অদ্ভুত স্যাডনেস আছে।
অথচ এতটা হাসিখুসি!’
সবুজ আলোটা জ্বলুক...
কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একটা তারা জ্বলে উঠল। অন্ধকারে মৃত আলো ছড়িয়ে পড়ল কোন জানালায়??!!
প্রিয়তমার নতুন চিঠি
যেদিন তোমার আসার সময় হবে সেদিন পাখিরা-গাছেরা
আর রঙেরা চিনিয়ে দেবে পথ। তোমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে আসতে এগিয়ে যাব আমি। মনে পড়ে, এর আগের
চিঠিতে এমনটাই লিখেছিলাম? নদীর স্রোত বেয়ে সেই চিঠি হয়তো বা গিয়েছিল তোমার দেশে,
অনন্ত অপেক্ষার শেষে। হয়তো.....।
না লেখা চিঠির পোড়া কালো অক্ষরে ডুব দিয়ে আর বার করব না কোনো
স্বপ্নাতুর তারার আকাশ। যদি আসো, তবে দেখা দেবে পুরনো হৃদয়, তাকে ছুঁয়ে চলে যাবো ব্যস্ততম পিচঢালা পথে। আর দেখবো না ছায়ার মতন
তোমাকেও।
গ্যাস বেলুন
এই পৃথিবীতে কেউ চিরদিনের জন্য আসেনি –
তুমিও না আমিও না, কিন্তু আমাদের দুজনার ভেতর যে আছে, তার আসা-যাওয়ায় তোমার কোন
হাত নেই – তাকে তুমি ডেকে আনতে পারো না, ধরে রাখতেও নয় – আর ছেড়ে দেওয়া বা ছুঁড়ে
ফেলা? – হাঃ, কোনোটাই তোমাকে দিয়ে হবে না, .... আমাকে দিয়েও না – তবু আমাকে নাগালে
পেলেই সুতোয় বেঁধে রাখতে চাও, নাড়াচারা করতে চাও নিজের খুশিতে – মনের মতো করে,
চটকে আদর করো, আবার যখনতখন যেখানে সেখানে গিঁটও মারো – আর যখন এই নাগাল ছাড়িয়ে উড়ে
যাই আকাশের দিকে, তখন তাকিয়ে থাকো অবাক হয়ে, কখনও বা মুগ্ধ দৃষ্টিতে....।
ইসসস্ .... তোমার ওই দৃষ্টিটা যদি আগেও
থাকত,.... তবে দুজনে মিলেই আকাশে ভাসতাম।
কী মজা হতো, তাই না !!
....
স্ক্রীনে দুটি মুখ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে,
থেমে যাবার আগে রাতভর আঙুল চালায় কিবোর্ডে।
----------------------------
ভূমিকম্প
২৯ তারিখ। সুজন, দীপামণি,
বোড়োদা বা বৈশ্যর মতো আরো অনেকের সঙ্গে তারা তখন নোটার বোতামটা
টিপে দিয়ে বুথ থেকে বেরিয়ে আসছে আর হারিয়ে যাচ্ছে ভিড়ের ভেতর।
১৭ তারিখ। রঙিন ধ্বসে যাওয়া ঘরবাড়িগুলোর চারদিকে যেন হলুদ
ফিতের ঘের। ফিতের গায়ে সার দিয়ে অন্ধকারেও জ্বলছে physically unsafe শব্দ দুটো।
দুটো ছায়ামানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতিউতি-- চলাফেরায় সংশয় আর
প্রত্যাশা। একজন অন্য জনের কাছে ভাঙাচোরা গলায় জানতে চাইল, 'বাইচ্যা আসে
নিকি কেউ?' অন্ধকারে উত্তর ভেসে এলো--'কান খাড়া রাইখো, গুমরানির আওয়াজ পাইতে পারো।'
--'কাছে কাছেই থাইকো বাই।'
--'তখন থিকাই তো আছি, চিন্তা কোইরো না।'
--'কিন্তু গুমরানির আওয়াজ পাইলেই বা কি, কিছুই তো করার নাই।'
--'কেন? দুইহাতে ইট-পাথরের জঞ্জাল সরাইয়া পরাণডা
বাচাইতে ত পারবা!'
--'একলা হাতে পারুম ক্যামনে এইসব!'
--'হা হা হা। আমার হাত দুইটা আছে
কী করতে বন্ধু!'
--'তোমার ওই হাত...!' অন্ধকারেও ছায়ামানুষটির গলা
কাঁপল অবিশ্বাসে।
--'কেন! আমরা দুইজনে মিল্যা কি ইঁটের ধামা তুইল্যা নিসি না? মাখা মশলার কড়াইগুলা হাতে হাতে কালুমিস্ত্রির ছেনির পাশে থুইয়া আই নাই?
আমার খাউড়া বিড়িখান হাত বাড়াইয়া লও নাই?'
--'হ, হেইগুলি ত করসি। এক মালিকের আণ্ডারে একলগে থাকলে
হইবই। তবু....।'
দ্বিতীয়জনের মুখে করুণ হাসি খেলে গেল।
১৬
তারিখ। হৃৎস্পন্দন এখনও কান পাতলে শোনা যাবে, এতটাই ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে
ভূমিকম্পে।-------------
No comments:
Post a Comment
Note: only a member of this blog may post a comment.