Saturday, 21 May 2011

উনিশের ভাবনা

উনিশের গণ্ডি -- উনিশের মুক্তি
          কতবার বর্তমান হয়ে গেছে ব্যথিত অতীত -- জীবনানন্দের এই উক্তিকে উনিশে মে সম্পর্কে আজ বড়ই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। সত্যিই তো, পায়ে পায়ে পঞ্চাশটা বছর পেরিয়ে এলাম। কত স্মৃতি, কত কথা, কত গান, কত কবিতা, কত গল্প। উনিশকে নিয়ে বইও লেখা হয়ে গেছে বেশ কিছু। তবু ব্যথিত অতীত বারেবারেই ছবির মতন ফুটে ওঠে। একদিকে যেমন জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে বারবার আন্দোলিত হয়েছে ভুবনায়িত জীবন, অন্যদিকে তেমনি একরাশ হতাশা। একদিকে তার প্রাপ্তি অন্যদিকে তার পরিসরহীনতা। এই দ্বান্দ্বিকতা নিয়েই আজকের উনিশ। 
            সময়ের প্রবাহে পঞ্চাশটা বছর কম নয়। বাংলাদেশের ভাষা-সংগ্রাম আটচল্লিশ বছরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই হিসাবে উনিশের বলিদান বিশেষ কিছুই লাভ করেনি। শুধু উনিশ কেন, পরবর্তীতেও বরাক উপত্যকায় ভাষা-মায়ের পায়ে যে সমস্ত প্রাণ নিবেদিত হয়েছে, জনমানসে তার স্বীকৃতির পরিসর সীমিত। অবশ্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপত্যকার সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে প্রাপ্তি বলেই স্বীকার করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, উপত্যকাভিত্তিক ভাষা ব্যবহারের এই সরকারি নীতি শেষ পর্যন্ত সেখানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। একটি স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছিল এভাবেই। তবে এই সাফল্য এবং হাল আমলে দিল্লী, কলকাতা বা অন্যত্র কয়েকটি স্মৃতিচারণমূলক সভাকে যদি উনিশের স্বীকৃতিমূলক বিস্তার বলে ধরে নেওয়া হয় তবে তা হবে একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবির গ্রন্থনা। বছরের পর বছর সেই অ্যালবামে ছবি জমা হচ্ছে। গুণীজনেরা বলেন, প্রবলভাবে যা বর্তমান ছিল কখনও তা যখন স্মৃতির গ্রন্থনা মাত্র হয়ে দাঁড়ায়, ধাবমান সময়প্রবাহের পক্ষে সমস্তটা হয়ে পড়ে অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক। এটাই কি তাহলে উনিশের ভবিতব্য? অর্ধ শতক পেরিয়ে যাবার পর আজ কি সে শুধু অমলিন গৌরবময় 'পটে লিখা' ছবি? 
          কিছুদিন আগে এই অভাজন একটি লেখায় বলেছিলেন, উনিশে মে-র ঘটনা বর্তমান প্রজন্মের কাছে 'দূরতর ইতিহাস'। পরবর্তী পাঠক প্রতিক্রিয়ায় এই বক্তব্যকে অস্বীকারও করা হয়নি। তবু আজ যদি কোনও আগ্রহী পড়ুয়া উনিশের ভাবনাকে জানতে চান, তবে কি তাঁকে বরাকের ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন উত্তাপ আর পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বয়ান শুনেই তৃপ্ত থাকতে হবে? উনিশ যা দিয়েছে তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক বিস্তৃত সময়ের ইতিহাস। আজ তাকে জেনে নেওয়া শ্রমসাধ্য হলেও দুঃসাধ্য নয়। অতএব প্রত্যক্ষভাবে বরাকভূমি সংলগ্ন না হয়েও আজকের অনুসন্ধিত্সু সেই কালনির্দিষ্ট আবেগকে আত্মস্থ করে নিতে পারবেন। সময়ের দূরত্বের জন্য তাঁর সঙ্গে উনিশের নৈর্ব্যক্তিক যোগাযোগ গড়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। তখন উনিশ-সংলগ্ন ইতিহাস তাঁর কাছে আর একমাত্রিকতায় ধরা দেবে না। কেউ যদি ১৯৬১র মে মাসের সেই দগ্ধ দুপুরে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশি বর্বতার পূর্বাপর বৃত্তান্ত নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হন তবে ওই নতুন পড়ুয়ার নৈর্ব্যক্তিক মন আরও এক বৃত্তান্তকে খুঁজে নেবে -- বৈপরীত্যই যার প্রকৃতি। কেননা যে-কোনও পরিস্থিতিই ন্যূনতম দ্বিমাত্রিক। বর্তমানের সচেতন মনন সেই দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতিতে সত্য আবিষ্কারেই মন দেবেন। কোনও অন্ধগলির দিকে এগিয়ে যাওয়া তাঁর কাম্য হবে না। তখনই তিনি উনিশের ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। তখন তিনি জানতে চাইবেন উনিশের সম্ভাবনাকে -- উনিশ কী দিতে পারে , সেই অনুসন্ধানে তিনি ঋদ্ধ হতে পারেন। উল্টোদিকে, স্মৃতির গ্রন্থনা তাঁকে নিরুত্সাহিতই করবে। 
          উনিশের ভাবনা নির্মাণে আঞ্চলিকতার নির্মোক খসিয়ে ফেলার সাম্প্রতিক প্রয়াস আমাদের চোখে পড়েছে। বলা হচ্ছে, উনিশ মানে একটি সাংস্কৃতিক বহুত্বের মাঝে প্রত্যেকটি এককের ফুটে ওঠার অধিকার। প্রত্যেকটি একক যখন একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে, প্রত্যেকটি একক যখন একে অপরের প্রেরণা হয়ে ওঠে, তখনই মূর্ত হয় উনিশের চেতনা। বরাক উপত্যকার সাংস্কৃতিক প্রতীক নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের আবহমান সংস্কৃতিধারার বর্ণালীর প্রতিনিধি হিসাবে উনিশকে দেখা হচ্ছে। এই উপলব্ধির সম্প্রসারণ ভাবীকালকে অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে।
           উত্তর-পূর্বের বহুমাত্রিক ও জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক-ভাষিক সংস্থান বা বিন্যাস কোনও একক সংস্কৃতি নির্মাণে সক্ষম হয়নি। বরং সংস্কৃতির বৈচিত্র্যই এখানকার বিশিষ্টতা। সেখানে একটি মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বিশেষ আবেগ জনমনে তৈরি হয়েছে তা কতটা ওই বৈচিত্র্যের কাছে নিজেকে মেলে ধরতে পারে? তার আভ্যন্তরীণ শক্তি কতটা যা সমস্ত বিচ্ছিন্নতাকে দূরে সরিয়ে পারস্পরিক বন্ধনকে নিবিড় করতে পারে? বৈচিত্র্যকে, যে-কোনও ভাবেই হোক, যদি অস্বীকার করি তাহলে নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়। তবে সহাবস্থান অবশ্যই অগ্রাধিকার পেতে পারে। এবং সেই পরিস্থিতি যে একান্ত অসম্ভব, তা আশা করি কেউ বলবেন না। প্রত্যেক মানুষই শান্তি চান, সুস্থিতি চান। আর এই চাহিদাকে মেটাতে গিয়ে একে অপরের পরিপূরক বা প্রেরণা হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। 
            কিন্তু আধুনিক বিশ্বে যখন আমরা প্রগতির কথা ভাবি তখন এই 'অপর'এর অস্তিত্বটা আর নেহাত পরিপূরক বা প্রেরণাদাতার সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে না। অন্তত আমরা যতদিন না আধিপত্যহীন সমাজব্যবস্থার জন্ম দিতে পারছি ততদিন এই 'অপর' থাকবে এবং তাকে নানাভাবে গ্রাস করবার চেষ্টাও থাকবে অব্যাহত। সুতরাং যখনই 'উনিশ' সাংস্কৃতিক বহুত্বের মাঝে সমন্বয়ের একক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইবে তখনই সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। কারণ 'উনিশ' ভাষা আন্দোলন-মুদ্রার একটি পিঠ। সেই পিঠে যেমন বরাকপারের এগারো শহিদের ছাপ রয়েছে, তেমনই মুদ্রার অন্য পিঠে আছে ব্রহ্মপুত্রতীরের র়ঞ্জিত বরপূজারি সহ বহু ভাষাপ্রেমিক ও অস্তিত্ব সচেতন যুবকের রক্তচিহ্ন। কোনও কোনও ভাষাপ্রেমীর চিন্তায় তাই বরাকপারের মানুষ তাঁদের ভৌগোলিক পরিসর সহ ভাষিক পরিচয়ে কখনও কখনও অসমেরই আপনজন হয়ে ওঠেন। অথচ বরাকপারের মানুষ বা বাংলা ভাষার ইতিহাস যে একথা মেনে নিতে পারে, তেমন কোনও সম্ভাবনা এখনও তৈরি হয়নি। এই চরম দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতিতে আঞ্চলিকতার বোধকে দূরে সরিয়ে রাখার কথাটা যত উন্নত চিন্তাঋদ্ধ হোক, আসলে বাস্তবতার সম্পর্কহীন এক প্রকল্প মাত্র।
           একথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে, উনিশ যা দিতে পারে তা ভাষাকে কেন্দ্র করেই ব্যাপ্তি পেতে সক্ষম। সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের মতো ভাষা-বৈচিত্র্য যখন অসম তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তখন এই বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে নিয়ে এতদঞ্চলের প্রত্যেকটি ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোই আজকের লক্ষ্য হওয়া উচিত। পৃথিবীর উন্নত দেশ বলে পরিচিত হোক বা তাকে আধুনিক বিশ্বই বলি, -- সবারই প্রগতির অবলম্বন মাতৃভাষা। ঔপনিবেশিকতাকে আঁকড়ে ধরেছি বলেই আমরা মাতৃভাষাকে অবহেলা করি। আর বোধহয় সেজন্যই প্রতিবেশীর ভাষাকেও যোগ্য সম্মান দিতে কুণ্ঠিত হই। ভাষার অবমাননা আজ দিকে দিকে, নানা রূপে। কিন্তু বরাকের ইতিহাসে 'উনিশ' এসেছিল ভাষাকে অবলম্বন করেই। অতএব ভাষাকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়েই এই দিনটি তার প্রাপ্য মর্যাদা পেতে পারে।
              কোনও ভাষাই অবগাহনে বাধা দেয় না। ভিন্ন ভাষাশিক্ষার প্রতি আমাদের যে অনীহা আছে সেটাও নয়। অতএব উনিশ যদি সমস্ত অসূয়াকে দূর করে আজকের (উনিশে মে) দিনটি অন্য ভাষা জানবার দিন হিসাবে উত্সর্গ করে, তাহলে খুব একটা ক্ষতি হবে কি? অন্যকে জানা মানেই তো নিজেকে জানা, নিজের জ্ঞানরাজ্যকে বিকশিত করে তোলার চেষ্টা করা। এটা যদি হয়, তবে 'উনিশ' তার নিজস্ব গণ্ডির বাইরে গিয়ে একটা উত্কর্ষ পায়। এমনকী বহির্বিশ্বের কাছেও উনিশের ভাবনা তাহলে একটা তাত্পর্য লাভ করে। তখন আর মনে হবে না যে, আরেকটি উনিশে মে আরেকটি অতীত স্মৃতির গ্রন্থনা। তখন তা হয়ে উঠবে শাশ্বত, চিরন্তন। তবু একটি কঠিন জিজ্ঞাসা দিয়েই শেষ করব, -- আমরা কী আমাদের সমস্ত দ্বান্দ্বিকতার উপরে উঠতে পারব? পারলে কবে, কোন উনিশে মে-তে? 
--------------

3 comments:

  1. দুর্দান্ত লেখা। ভবিষ্যতে এই লেখার/ এমন লেখার আরো বিস্তৃতি চাই।

    ReplyDelete
  2. অন্যের ভাষা জানার দিন হিসাবে ১৯কে উৎসর্গ করা - অত্যন্ত জরুরি এক প্রস্তাব। কিন্তু, বরাকই হোক, বা পূর্ববঙ্গ - প্রশাসনিক তরফে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও তাকে কাজের জগতে ব্যবহার কোরতে বাঙালির যখন অনীহা, এপার-ওপার দুই বাংলাতেই যখন বাংলা ভাষার প্রতি মমতা নতুন প্রজন্মের মধ্যে গড়ে উঠছে না, বাড়ছে ইংরেজির কদর শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে শুধু নয়, দৈনন্দিন কথাবার্তা আর অনানুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মেও, এমনকি যারা বছর-বছর ঘটা কোরে পালন করেন ১৯ কিংবা ২১, তারা নিজেরাও যখন বছরের বাকি দিনগুলো ইংরাজি-সর্বস্ব হোয়ে কাটান, তখন খুব হতাশ লাগে, মনে হয়, বাঙালি নিজেই যখন নিজের আত্মপরিচয়কে ধ্রে রাখতে অনাগ্রহী, তখন ১৯-২১ পালন কোরে কি হবে?

    ReplyDelete
  3. আপনার এই লেখাটা এবারে আমি শিলচরের একটি মাসিক কাগজে দিচ্ছি। এটির প্রচার কম , কিন্তু বৌডধিক সমাজে কদর আছে। নাম পরে বলবে। ১৯ নিয়ে এই লেখা পড়ে দেখুন, আপনার ভালো লাগতে পারেঃhttp://swabhimanngo.blogspot.com/2011/05/comments-on-relevance-19th-may-in.html#more

    ReplyDelete

Note: only a member of this blog may post a comment.