Monday 16 January 2017

লক্ষ্মীর পাঁচালি (গল্প)



লক্ষ্মীর পাঁচালি

জ্যো তি র্ম  সে গু প্ত 

জল ঝরছে অঝোরে কখনও একটু থামছে, ঝিরিঝিরি থেকে টিপটিপ তারপর আবার...... রাস্তায় কাদা থিকথিক পুরনো বাঁশের বাতা আর মরচে ধরা তারের বাঁধনে চেনা-অচেনা গাছপালাগুলো বিধু সরকারের কাঠাখানেক জমিকে ঘিরে রেখেছে দুপুরের আলোয় বিষণ্ণতার ছোঁয়া ঠিক সেই সময় দাওয়ায় তার কাদা মাখানো একজোড়া পায়ের ছাপ পড়েই গেলভেতর থেকে দুটো কড়া চোখের চাহনি সশব্দে আছড়ে পড়ল ঐ কাদামাখা ছাপের পায়ে – ‘লক্ষ্মী না’!!?
দুটো পা আর তার ল্যাপটানো কাদাছাপ আটকে গেল ওখানেই। মুখটা নেমে এল বুকে ঢিপঢিপ শব্দটা দলা পাকিয়ে উঠতে লাগল গলা লক্ষ্য করে। কানে এল ভেতর থেকে কয়েক জোড়া পায়ের দুপদাপ আওয়াজ, ‘কে, কেগো? কে এলো?!! অ্যাঁ তুই...!?’
সোজা তাকাতে সাহস হল না, কিন্তু সামান্য মুখ তুলে চোখের কোনা দিয়ে দেখল পিসিমা দরজা আগলে দাঁড়িয়েছেন, আর তাঁর প্রসারিত দুবাহুর দেয়াল ডিঙিয়ে আরও দু-তিনটি উৎসুক চোখ। এতদিন পর কইত্থাইকা আইলি মুখপুড়ি? লক্ষ্মীছাড়াটা আসে নাই? একা আইসস? বাচ্চাদুইটা কই? তা হেইগুলানরে খাইয়া আইলি নাকি মরার মাগী!!?’ তার কানের ভেতর দিয়ে যেন গরম সীসে কে ঢেলে দিচ্ছে। বুকের দলাটা ততক্ষণে বোবা মুখ থেকে আরও ওপরে উঠে চোখের কোণ বেয়ে গড়াতে শুরু করেছে। মাথাটাও কি একটু ঘুরে উঠল?
লক্ষ্মী, নারে দেবি? আইসে ক্যান জিগা তো!’ না, এ রুক্ষ প্রশ্নের জবাব আর সে দিতে পারল না। তার আগেই মনে হল সে হাল্কা হয়ে যাচ্ছে, একটা কালো চক্কর, ব্যস আর কিছু নয়।
দেবি পিসি ছুটে এসে কোলের ওপর মাথাটা না রাখলে হয়ত দাওয়াতেই গড়িয়ে পড়ত দু-তিন মিনিট মনে হল সে অন্ধকারে ভাসছে। তারপর আবছা ভেসে উঠছে

কয়েকটা মুখ, চারপাশ থেকে কানে আসছে গোমড়া আওয়াজ। উঠে বসার চেষ্টা করল সে, পারল না। কে কি বলছে তাও সে বুঝতে পারছে না। শুধু তার মনে হচ্ছে একটু উঠে বসতে হবে, কথাগুলো বলতে হবে কিন্তু চোখের পর্দায় ঝলকে উঠছে গলার শিরা ফোলানো একটা অসহায় শুকনো মুখ যার চোখের মণি ঠিকরে বেরিয়ে এসে যেন তাকে তাড়া করছেসে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কনুইতে ভর দিয়ে আবার চেষ্টা করল উঠে বসতে। এবার পিসিমার গলা কানে এলো – ‘উঠতে অইব না শুইয়া থাক একটুক্ষণ। অই গইন্যা ...... মারে কদুধটা গরম কইরা লইয়া আইতে।
--হ্যারে দুধ খাওয়াইবার কি কাম? বাইচ্চাগুলান কি উনা প্যাটে থাকব? আকাশের অবস্থা দেখতাসস না? এর পরে তো খাওনের লেইগ্যা খড়কুটাটাও পাওন যাইব না। চখে-মুখে জল ছিটাইয়া দে। উঠলে তগো লগে দুইডা শুদা ভাত খাওয়াইয়া দিস পিয়াজ আর লঙ্কা পোড়া দিয়া
-- চুপ করো তো তুমি, আমি দ্যাখতাসি কি করন যায়।
বাবা আর পিসির কথাগুলো এবার তার কানে ঢুকল ঠিকঠাক। সে বলতে চাইল যে তার খাবার চাই না, না দিলেও কিছু করার নেইবরং যা সে হারিয়েছে তার কিছুটা যদি এখান থেকে নিয়ে যেতে পারে তাতেই সে খুশি হবে। কিন্তু কথাটা তার মুখেই রয়ে গেল, গলার স্বর ফুটে বেরল না। চোখ দুটো সামনে বসা পিসিমার মুখের ওপর থেকে সরে গেল একবার বাঁয়ে, একবার ডানেতারপর আস্তে আস্তে ডানদিকের দেওয়াল বেয়ে কড়িকাঠ হয়ে বাঁ-দিকের দেওয়ালে ঘুলঘুলির আলে একটা শালিক দিনের ধূসরতা গায়ে মেখে ন্যাতানো পালকের ভেতর ভেজা ঠোঁট মুছতে চাইছে বার বার ঘরের ভেতরে আবছা অন্ধকার, সন্ধ্যে নামলে যদি কারেন্ট না আসে তবে হ্যারিকেন জ্বালানো হবে বোধহয় ডানদিকের দেওয়ালে কয়েকটা চেনা ছবি, মায়ের হাতের কাজযেমনওঁ পতি পরম গুরু’, ‘তব নামহি কেবলম’, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’এছাড়া আছে এ-বাড়ির একটা সম্পদ – কালো ফ্রেমে বাঁধানো একটা হলুদ হয়ে যাওয়া গ্রুপ ছবি।
সে ঠাকুরদাকে দেখেনি, এমনকি তাঁর কোনো ছবিও নয়। কিন্তু ছোটবেলাতেই শুনেছে ওই ছবিতে তার ঠাকুরদা আছেন। মাঝখানে গোল ফ্রেমের চশমা পরা গোলগাল লোকটি নাকি নেতাজি সুভাষ, ওর ঠিক পেছনে দ্বিতীয় সারিতে দাঁড়ানো দাড়িওয়ালা মানুষটি নাকি তার ঠাকুরদাদা। আই.এন.এ-র সঙ্গে এসেছিলেন, তারপর বন্দী। ছাড়া পেয়ে নাকি তিনি কোহিমা থেকে নেমে লামডিঙে মাথা গুঁজেছিলেন সঙ্গে পরিবার বলতে খুড়তুতো ভাই তার বউ আর মা-মরা একমাত্র ছেলে রেললাইন পাতার কাজ তখনও শেষ হয়নি লোকালয় বলতে কালীবাড়ি সংলগ্ন অঞ্চল আর ছোট্ট রেল স্টেশনকে ঘিরে দুপাশে রেলবাবুদের বসতি একদিক থেকে অন্য দিকে যাবার উপায় মাঝখানের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একটি পায়ে চলা সরু সরলরেখা স্টেশনের ওপারে পূবদিকে একটা উঁচু টিলার ওপর রেলসাহেবদের বাংলো, টেনিস খেলার কোর্ট আর ক্লাব ঠাকুরদা কালীবাড়ির পেছনে ফরেস্ট এরিয়ায় একটি কাঠের তৈরি বাড়িতেই এসে উঠেছিলেন আর সেখানেই তিনি মারা যান পঞ্চাশ সনে অভিভাবকহীন বাবা তখন এদিক ওদিক ঘুরে রেলের স্লিপার পাতার কাজে লেগে গিয়েছিলেন কাকা-কাকিমাকে ছেড়ে থাকতে শুরু করেন লাইনের পারে রেল-গুমটিতেসেখানেই মা-কে খুঁজে পেয়েছিলেন।  কিন্তু সুন্দরী ছিলেন বলে মায়ের ওপর অনেকের নজর ছিল, তাই বাবা মা-কে নিয়ে পালিয়েছিলেন ভবঘুরেদের জীবনে সেসব কাহিনি রূপকথার গল্পের মতো শোনায় মা- বিবাহিত জীবনের  শুরু থেকেই লড়াই পেট চালাতে শুরু করেন শালপাতা, শুকনো গাছের ডাল, ঘুঁটে বিক্রির কাজ দুজনের কারোই পেটে বিদ্যে ছিল না বাবাও এটা সেটা করে দিন কাটাচ্ছিলেন বাজারে চায়ের দোকান চালাতে চালাতেই হঠাৎ ভাগ্য খুলে গেল কাঠের মিলে তদারকির কাজ মিলল দুটো পয়সা হল, মায়ের কোলে লক্ষ্মী আর নারায়ণ এলো মিল মালিকের বদান্যতায় এই ওদালির কিনারায় এক টুকরো জমি পেলেন তিনি, আসলে চৌকিদারি করবার প্রতিদান ফরেস্ট এরিয়া, মালিকের ইজারা নেওয়াসুতরাং জমি বিলি তাঁর হাতের মুঠোয় দশবারো ঘর বসতি নিয়ে গোটা একটা পাড়াই হয়ে গেল দরমার বেড়া আর পাতলা টিনে ছাওয়া ঘরে বাবা এসে উঠলেন সঙ্গে দেবি পিসি আর কাজলা ঠাকমা দেবি পিসি তার আপন কেউ নয়, কিন্তু নিজের পরিজনের চেয়েও বেশি কাছের কাঠ চেরাইয়ের কলে পিসির দাদা বেঘোরে জান দেওয়ার পর থেকে বাবাই পরিবারের বাকি দুজনের অভিভাবক সুতরাং মা ছাড়া অন্য দুজন মহিলার কোলে পিঠেই -বাড়িতে তার বেড়ে ওঠা সে বুঝতে পারছে, বাবার রাগ এখনও পড়েনি মা নেই, ঠাকমাও সেই কবেই গত হয়েছেন; এমন দিনে পিসিই তার একমাত্র ভরসা
হলুদ হয়ে যাওয়া ছবিটা থেকে চোখ সরিয়ে এবার সে পিসির মুখটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করল ততক্ষণে ঘরের ভেতর আরেকটু অন্ধকার নেমে এসেছে বৃষ্টিটাও জোর বাড়িয়েছে কারেন্ট নেই, একশ ওয়াটের বালবটা তাই বোবা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে পিসির কাছ থেকে কি ছবিটা ধার নেওয়া যায়? পিসি যদি বাবাকে বলে ছবিটা তাকে দেন – অন্তত কয়েকটা দিনের জন্য? কিন্তু এই ছবি নিয়েই বা কি কাজ হবে? বরং এটার চেয়ে অনেক বেশি কাজে দেবে কোন একটা ছাপমারা কাগজ। কোথায় আছে সেই গুপ্তধন? এখানে থাকতে সে কখনও ভোট দেয়নি, তাই ভোটের কাগজ যে নেই সে বিষয়ে সে নিশ্চিত। কিন্তু কাগজই তার চাই কি না সেটাও তো তার জানা নেই। তাকে তো জানাতে হবে কানাইয়ের বাপের কথা, শ্বশুরের কথা। পিসিরা কি সেসব শুনতে চাইবে? কথাগুলো দলা হয়ে বুকে আটকে আছে। সে শুয়ে শুয়ে পিসির মুখের রেখাগুলো পড়ে নিতে চাইছে। কিন্তু বৃষ্টি আর অন্ধকারের যুগলবন্দীতে তার দৃষ্টি আর মনের কথাগুলো দোল খাচ্ছে।
‘এখন একটু ভালো লাগতাসে? দুধটা খাবি?’ – পিসির কথায় সে যেন একটু সম্বিৎ ফিরে পেল। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে সে টের পায়নি কখন গইন্যা না গনা বলে ওই বাচ্চা ছেলেটি একটা দুধের গ্লাস পিসির হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেছে। ছেলেটার মাও এসে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে ননদের অবস্থা আঁচ করতে চেষ্টা করেছে আবার চলে গেছে নিজের কাজে কিন্তু এসব ঘটনা তার চোখের আড়ালে ঘটে গেছে এখন তার বিছানায় দেবী পিসিই একা বসে আছে সে কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করতেই পিসি একহাতে দুধের গেলাসটা ধরে অন্য হাতটা তার ঘাড়ের নীচে পেতে দিলেন‘ উইঠ্যা ববি? দেখিস মাথাটা আর ঘুরায় না তো? না সে ঠিক আছে, এখন অনেকটা ভালো লাগছে পিসির বাড়ানো গ্লাসটা সে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল তারপর এক ঢোকে সমস্ত দুধটা খেয়ে ফেলল হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে সত্যিই খিদে পেয়েছিল। ওঘর থেকে বাবা লুঙ্গির গিঁটটা ঠিক করতে করতে এগিয়ে এলেন – ‘ বড় সাদ কইরা নামখান থুইসিলাম, লক্ষ্মী – হাঃ, ধনের দেবী। কই আর ধন! উল্টা সব ভাসাইয়া গেলি গিয়া। অখন আবার ফিইরা আইলি ক্যান কে জানে!’
‘তুমি আবার উইঠ্যা আইলা ক্যান। কইলাম না দ্যাখতাসি।’ পিসি একটু ধমকের সুরেই বাবাকে কথা দুটো বললেন। ‘হ, রাখ। তুই আর কি দেখবি। আমি আওন দেইখ্যাই বুজছি।’ — মেয়ের দিকে তাকালেন এবার তিনি। বাবা মেয়ের চোখে চোখে মিলন আবার বহুদিন পর হচ্ছে। সে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। বোবা কান্নায় ভেঙে পড়ল পিসিমার কাঁধে
‘আঃ তুমি যাও দেখি। গইন্যার মায়রে কও সন্ধাবাতিটা দিতে।’
না, বোনের কথায় বিপিন সরে গেলেন না। বরং মেয়ের রকম-সকম বুঝতে চেষ্টা করলেন। দেখলেন সিঁথিতে সিঁদুর আছে কি না, হাতে নোয়া-শাঁখা আছে কি না। না নেই, শুধু মনোরমার দুগাছা চুড়ির ভেতর  একখানা যে আছে তা ঠাহর করলেন। ‘জানতাম, আমি ঠিক জানতাম। এইরকমই কিসু একটা হইব।’
দাদার উচ্চকণ্ঠ দেবী পিসি আর তাকে চমকে দিল। দুজনেই বিপিনের দিকে চোখ ফেরালেন দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আরও দু-তিনজোড়া উৎসুক চোখ তারা বিপিনের চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে ‘নির্ঘাত এই মাইয়া সব খাইয়া আইসে। দ্যাখ দ্যাখ! মাথায় সিন্দুর নাই হাতে বিয়াত্তের কোন চিন্ন নাই। মাইয়ারে সোহাগ কইরা মায় একজোড়া চুরি দিসিল, দ্যাখ তার একখানই আসে।’
পিসি এবার লক্ষ্মীর হাতখানা টেনে নিলেন। সত্যি তো! একেবারে খালি, এয়োতির কোন চিহ্নই নেই। সিঁথিও শূন্য। আচ্ছা সে নাহয় জলে ভিজে ধুয়ে গেছে। কিন্তু হাতে শাখা-পলা তো থাকবে! তিনি লক্ষ্মীর চোখে চোখ রাখলেন।  কিছু জিজ্ঞাসা, অনেক উত্তর এইসময় ঘরের অন্ধকারে ঘোরাফেরা করছে কিন্তু সে এবার পিসির হাত ছাড়িয়ে বিছানা থেকে প্রায় লাফিয়ে নামল আর জলের ঢেউয়ের মতো বাবার বুকে আছড়ে পড়ল বিপিনের হাতদুটো আস্তে আস্তে মন্ত্রচালিতের মতো মেয়ের পিঠে আর মাথায় এসে ঠেকেছে তার মনে হল, এতদিন পর একটু যেন কোথাও শান্তিতে মাথা রাখার জায়গা পাওয়া গেছে
বাপ-মেয়ের মান-অভিমান পালায় পিসি বেশিক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারলেন না – ‘অতক্ষণ ত কত শাপ-শাপান্ত করতাসিলা। অখন দেখি সোহাগের বইন্যা বইতাসে। মাইয়া ক্যান আইসে ঘুইরা, জিগাইবা না?’ বিপিনের চোখে জলের রেখা দেখা গেল। সেটা নজরে আসতেই পিসি আবার মুখ খুললেন – ‘মাইয়া ঘরের লক্ষ্মী, বুঝছ। সে ঘরে আসে মানে ঘর আলো হয়, সংসারে সোনা ফলে। আর তুমি তাড়াইয়া দিতে চাইসিলা। পারলা?
হঠাৎ করে মেয়েকে বুকের মাঘে পেয়ে বিপিন বিহ্বল হয়ে গেলেন, আপনিই মনটা বর্ষার জলে ভেজা বাইরের মাঠের মতই থিকথিকে হয়ে উঠল। মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তিনি বললেন – ‘মাইয়াডা ঠিক তার মায়ের মতন হইসে। কিসু হইলে এই বাপ ছাড়া আর কাউরে লাগে না।’ ঠিক এই সময় কারেন্ট এলো, একশো পাওয়ারের বালবটা জ্বলে উঠতেই ঘরময় আলো ছড়িয়ে গেল। সে তখনও বাবার বুকে মুখ গুঁজে। ‘অই দ্যাখ, মাইয়ার কাণ্ড। এত কান্দে না মা। যা হইবার তা তো হইসেই। অরা তরে খুব দুঃখ দিসে, না রে!? পোলাপান দুইটারে দ্যাখনের বড় হাউস আসিল। যাউক যা হইবার হইব। হ্যারা যদি আইতে দ্যায় নাই তো কি করবি! আমি যামু নে পরে। যা অখন একটু পিসির কাসে ব। খাইয়া-দাইয়া সব কথা শুনুম নে। নে দেবি, ধর, অরে একটু সামলা।’
দেবী ভাইঝিকে কাছে টেনে বসালেন। দরজার কাছ থেকে উৎসুক চোখগুলো সরে গেল। তাদের এখন অন্যত্র আসর জমাবার পালা। ওদিক থেকে শাঁখের শব্দ শোনা যাচ্ছে, ধুপকাঠির গন্ধটাও ভেসে আসছে। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গনার মায়ের পাঁচালিও এঘর থেকে শোনা যাচ্ছে – ‘যে বা পড়ে, যে বা শোনে, যে বা রাখে ঘরে, লক্ষ্মীর কৃপায় তার ধনে জনে বাড়ে।...’


()
সুধেন্দুর চিতার আগুন তখনও নেভেনি চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকজন আগুনের শিখায় তারা প্রত্যেকেই লালাভ দুটি শিশু একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিহ্বল হয়ে দেখছে তাদের পাশে উপুড় হয়ে পড়ে আছে লক্ষ্মী
একটু আগে দেবুকে নিয়ে এসেছিল ওরা দশ মিনিট বড়জোড় ছিল থান কাপড় জড়িয়ে মুখাগ্নি করতে যতটুকু সময় তার সঙ্গে দুটো কথে বলাও হয়নি ছেলেদুটো একবার দৌড়ে গিয়েছিল তাদের বাবার হাত ধরার জন্য কিন্তু খাকি পোষাকের রক্তচক্ষুকে ডিঙিয়ে তাদের পক্ষে বাবার কাছে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি
দেবু একবারের জন্যও লক্ষ্মীর দিকে তাকায়নি অন্তত লক্ষ্মীর তা চোখে পড়েনি শুধু মনে হয়েছিল কানাইয়ের বাপ একবার যেন ছেলেদুটোকে খুঁজল সারাক্ষণ দেবু সুধেন্দুমোহনের নিথর দেহের চারদিকে কাঠবোঝাই চিতাটার দিকেই তাকিয়ে ছিল শ্মশানে মড়া পোড়ানোর ঢিবিটার পাশে যে কালো জলের ধারাটা আছে সেখানে তার স্নান হল, একটা ময়লা থান কাপড় তার কোমরে জড়ানো হল, একটা আধময়লা লাল গামছা দিয়ে মাথাটা মুছে নিয়ে সেটা সে কাঁধে ফেলল, তারপর চলল বাপের সাজানো চিতার কাছে ডানপা থেকে লোহার শেকলটা তখনও খোলা হয়নি সেটা নিয়েই ঘষটে ঘষটে পারে উঠল বসন্ত সর্দারেরা পাড়ায় বামুন খুঁজে পায়নি খবর শুনে দেবুর এক সবজি ব্যাপারি দোস্ত চলে এসেছে পারমার্থিক কাজগুলো করতে তার বাড়ির কুলুঙ্গি থেকে ছেঁড়া গীতাটা নিয়ে এসে ওটা দিয়েই কাজ চালাচ্ছে দাহকর্মটা উতরে দেওয়া আর কি তাই মন্ত্রোচ্চারণে কোন আড়ম্বর নেই না কথকের না শ্রোতার যন্ত্রচালিতের মতো দেবু দোস্তের হাত থেকে জ্বলন্ত পাটকাঠিগুলো নিয়ে তিনিপাক ঘুরল চিতার চারদিকে, তারপর গুঁজে দিল সাজানো কাঠের ফাঁক দিয়ে লক্ষ্মীর সঙ্গে তখন তার গলা মিলিয়ে বাবাগো বলে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল কি না, কেউ জানে না তবে আগুনের আভায় তার চোয়ালের ভেতর বসানো হাড়গুলোকে উদ্ধত হয়ে ঊঠতে দেখা যাচ্ছিল, চোখের মণিতে ঝলসে উঠছিল আগুনের শিখা
লক্ষ্মীর চিৎকার আর কাঠফাটার আওয়াজ ছাড়া আর সবকিছুই ছিল শুনশান এমনকি চিতার অল্প দূরে যে ছোট্ট কালো জলের নালাটা আছে, যেখানকার নোংরা জল  আজ সুধেন্দুমোহনের কাছে গঙ্গা তারও বয়ে যাবার কোন আওয়াজ নেই একটা অজানা আশঙ্কায় সাবাই চুপ লক্ষ্মীর চিৎকারটা সত্যি, কিন্তু কতটা যথার্থ তা শ্মশানে উপস্থিত বাকি লোকেদের জানা নেই যারা আইনের রক্ষক তাদের কারো মন গলিয়ে দেবার মতো শক্তি লক্ষ্মীর চিৎকারে নেই বরং থানার ছোটবাবুর হাবভাব দেখে মনে হয় লক্ষীকে থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে বরাবরের জন্য তাকে চুপ করিয়ে দিতে পারেন কিন্তু না, শুধু একবার লক্ষ্মীর মাথায়-পিঠে লোমশ হাতখানা বুলিয়েই তিনি সরে গেলেন হাবিলদারটাকে নির্দেশ দিলেন, চল, ব্যাটাকে নিয়ে ভ্যানে ওঠা
লক্ষ্মী কাতরভাবে চেঁচিয়ে উঠল, দারোগাবাবু, দারোগাবাবু গো, অরে লইয়া যাইয়েন না, কানাইয়ের বাপ ছাড়া আমার আর কেউ নাই গো বুড়া হউক খোড়া হউকবাপটাই ছিল মাথার উপ্রে পোলার শোকে শোকে সেও তো আর থাকল না অখন কানাইয়ের বাপ ছাড়া অগরে, আমারে আর কে দেখব গো অরে নিও না অরে নিও না অরে নিও না গো
ছোট দারোগার পা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে লক্ষ্মী কিন্তু অভ্যাসবশে দারোগাবাবু একটু দূরে সরে যান আর মুচকি হেসে বলেন, আমরা তো আছিই চিন্তা করিস না অসুবিধা হলে ক্যাম্পে আসিস তোর সোয়ামি তো রইলই আমাদের কাছে
দুজন কনস্টেবল এসবে ভ্রূক্ষেপ না করে দেবুকে হাতকড়া পরিয়ে ঠেলে তুলল প্রিজনভ্যানে অন্য দুজন লক্ষ্মীকে চ্যাংদোলা করে তুলে ছোটবাবুর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল লক্ষ্মী হাত-পা ছুঁড়ছে, কিন্তু ওরা দুজন লক্ষ্মীর চেয়ে অনেক বেশি সবল তাছাড়া বিস্রস্ত বেশবাসের ভেতর দিয়ে লক্ষ্মীর অযত্ন লালিত দেহাবয়ব ওই দুজনের চোখে যে অধরা থেকে গেছে তা- নয় মদ দায়িত্বের যৌথ উত্তেজনায় তাই টানাটানির পর্বটা একটু বেশিক্ষণ ধরেই চলছিল প্রিজনভ্যানের ড্রাইভার ছাড়াও অন্য দুজন হাবিলদার কাছেই ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে ছিল, বোধহয় সুযোগের অপেক্ষাতেই
সুধেন্দু যে ঠেলায় চড়ে এসেছিলেন তার মালিক বসন্ত সর্দার আর শ্মশানের চণ্ডাল চিতার আগুনটা চাগিয়ে দিতে ব্যস্ত হাতে জ্বলন্ত বাঁশ লক্ষ্মীর চিৎকার শুনে আর এই ধ্বস্তাধস্তি দেখে চণ্ডাল হেঁড়ে গলায় ডাক ছাড়ল চুপ কিজিয়ে না দিদিভাই, রোইয়ে মত এই হারামিলোগ ছোড় দো উনকো গলার আওয়াজে কি ছিল কে জানে, নাকি হাতে ওই জ্বলন্ত বাঁশটা দেখেইকনস্টেবলরা ধপ করে লক্ষ্মীকে মাটিতে ফেলে দিল ওদিক থেকে ঠিক তখনই ছোটবাবু গর্জালেন,অই শুওরের বাচ্চা চল আয় গাড়ি স্টার্ট দে
লক্ষ্মী ছাড়ান পেল কিন্তু সেখানেই উপুড় হয়ে পড়ে রইল তার গায়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে, ধুলো উড়িয়ে গাড়িটা চলে গেল অপস্রিয়মান গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওখানে উপস্থিত সবার মনে হল দুটো রক্তচোখ বিষদৃষ্টি ছড়িয়ে চলে যাচ্ছে লক্ষ্মীর চোখেও তখন ভেসে যাচ্ছে ওই রাঙা আলো
বসন্ত এসে লক্ষ্মীর কাছে এসে দাঁড়াল, ‘ দিদিভাই উঠ। কাইন্দ না। কি করবা কও। সবই আমাগো কপাল। শোক পাইলেও তোমার শ্বশুরের তো বয়স হইসিল। কিন্তু ...। উঠ উঠ। পোলা দুডারে একটু দ্যাহো। দাহ হইলে তাগো ক্রিয়াকর্ম করাইয়া নিয়া যামু নে ঘরে। উঠ, উইঠ্যা বস।’
লক্ষ্মী কাপড়চোপড় সামলে উঠে বসল। ছেলেদুটো গুটিগুটি পায়ে তার কাছে এসে দাঁড়াল – ‘মা...’। লক্ষ্মী তাদের বুকে টেনে নিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল।
বসন্তের স্ত্রীও এসেছে শ্মশানে। সেও লক্ষ্মীর পাশে দাঁড়িয়ে বিলাপ করতে শুরু করল, ‘বাপের চিতাটা পুরা জ্বলতেও দিল না, নিয়া গেল। কি পাষণ্ড! তোগ চইদ্দ গুষ্টি অলাউঠা হইয়া মরব। আমি যদি সতী হই, তো মা শীতলার কিরা – মরব মরব মরব। ... তুমি কাইন্দ না বইন, দেইখ্যো।
কানাইয়ের বাপরে কিসু করব না তো মাসি! অরে ছাইড়া দিব তো?
‘ছাড়ব না ক্যান! আমরা দেখতাসি না, সেই কবে ত্থিকা, দেবুর মতো শান্তশিষ্ট পোলা আর আসে নিকি? কি করল হে? আগে ঘরামির কাজ করত। কিসুদিন তো তোমাগো অইখানে দোকান দিয়াও চলছে। তারপরে ধরল প্যান্ডেল বানানির কাম। কই কোনোদিনও তো কারো লগে ঝগড়া মারামারি করতে দেখি নাই।’
‘কিছু না কোনোদিন না মাসি। আমার লগে কোনোদিন খারাপ কথা দুইটাও কয় নাই। থানায় গিয়া দারোগারে কইলাম। শুনে না। কইল, ক্যাম্পে যা। আমারে কয়, তোরা বাংলাদেশী। যত কই আমার জন্ম ওদালিতে আর হে হইসে গিয়া যমুনামুখের পোলা, মানেই না। খালি কয়, কাগজ লই আহ। সেই গুরি ত্থিকা অইখানে আসিলাম। কাছে পিঠে ইস্কুল নাই, পড়াও হইল না। লংকা পেরাইমারিতে দিসিল বাবায়, কিন্তু আসা যাওয়ার পয়সা নাই। চাইর কেলাস পর্যন্ত পইড়া আর গেলাম না, ঘরের কাম শিখলাম। হেরে দেখসি পান বিড়ির দোকান দিতেঘর বান্ধনের সুখে পলাইয়া আইলাম হ্যাগো ঘরে, তোমাগো পাইলাম। মাসি তুমি তো সেই সবই জানো।….  
হ্যারে ছাড়ানের লেইগ্যা মার হাতের একটা চুরিও দিলাম, অসুইরা বেটায় নিল হাত পাইত্যা। কিন্তু পরের দিন যাইয়া শুনি, কানাইয়ের বাপরে ক্যাম্পে চালান করসে। আমি কোটে গিয়া কাগজ দেখাইলে তবে ছাড়ব।
আমি কাগজের কি জানি মাসি। পোলাপান দুইটারে বড় করনের লেইগ্যা দিনে রাইতে কত কষ্ট করি। হ্যাগো বাপেও ঘুইরা ঘুইরা কাম করত। পুজা হউক বা মেলা – প্যান্ডেল বানানির কামে ডাক পড়ত। ফিরা আইত যখন বাপের লেইগ্যা ওষুধ, পোলাগো জামাকাপড় আমার লেইগ্যা গন্ধ পাউডার আনত। কিন্তু...’
বসন্তের স্ত্রী তাকে সান্ত্বনা দেয়, ‘সেইসব কথা জানিই রে বইন। ঘরে ফিইরা বুড়ার টেরাঙ্কের ভিতর দেখিস, কিসু পাইতে পারস। হেই কাগজ দেখাইয়া সোয়ামিরে ছাড়াইয়া নিয়া আইতে পারবি তুই জানি। ... কিন্তু দেবুর তো ছাদ্দের আগেই আইতে লাগব। হ্যারা ছাড়ব না? তুই কবি গিয়া। ছাড়ব ছাড়ব। কাগজটা নিয়া গিয়া দেখাইলে ঠিক ছাড়ব।’
‘ না মাসি, জিগাইসিলাম বাবারে, নিজেও খুজছি বহু, কোন কাগজ নাই। বাবায় অবশ্য কইসিল, কাগজ সবই আসিল – পাঁচ সনের বন্যায় সব গ্যাসে। হ মাসি, সেই রাইতের কথাও মনে আসে। হুরহুরাইয়া জল ঢুকল। কানাইয়ের বাপ প্যান্ডেল বানাইতে গ্যাসে পান্ডু। আমি একলা ওই আন্ধাইরের মইদ্যে বাপ আর পোলা দুইটারে লইয়া বান্ধে উঠসিলাম। দুইদিন পরে অগো বাপ আইসিল। জল নামনের পরে তো কেউ কিসসু আইয়া পাই নাই। আসলে আমি তখন প্রাণ বাচামু না কাগজ!’
‘দিদিভাই ঘরে চল। এইখানের কাম শ্যাস। অস্থিটা পড়ে আইসা লমুহনে – খুড়ার শ্যাস চিন্ন, ঘরে রাখবা, পরে মা গঙ্গারে দিয়া দিবা’—বসন্ত এসে দাঁড়ানোয় তাদের কথায় বাধা পড়ল। কখন যে সময় বয়ে গেছে লক্ষ্মী বা বসন্তের স্ত্রী খেয়াল করেনিওরা উঠল। সঙ্গের দু-চারজন যারা এসেছিল তারা একটু আগে এগিয়ে গেছে। বসন্তের স্ত্রী বাচ্চা ছেলেদুটোর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল শ্মশানের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে, পাশে লক্ষ্মী।
(৩)
অবসন্ন মনে লক্ষ্মী নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে।
জলজ্যান্ত খেটে খাওয়া মানুষটাকে বিনা কারনে জেলে ভরিয়ে রাখলে কারই বা ভালো লাগে! তাদের এমন সঙ্গতি নেই যে মাতব্বর কেউ সাহায্য করবে এই বিপদে। তাছাড়া এ জায়গাটার এমন কিছু নামডাক নেই যে মাতব্বরেরা এখানে অহরহ যাতায়াত করেনতবু আলতাফ জুটে গেল, দেবুর সঙ্গে একসময় ঘরামির কাজ করত।
কতদিন থেকে সুধেন্দুমোহনের পরিবার এখানে আছেন? হ্যাঁ, তা বছর দশেক তো হবেইতার আগে রিলিফ ক্যাম্পে, তার আগে নেলির ভেতরে একটি গ্রামে, তার আগে লংকা এন. এরিয়ায়, তারও আগে যমুনামুখে, তার আগে...? না, আর জানা নেই লক্ষ্মীর। যমুনামুখে থাকতেই তার শাশুড়ি মারা গিয়েছিলেন। বলতে গেলে কানাইয়ের বাপ তার বাপের কোলেপিঠেই মানুষ। কাজের খোঁজেই সুধেন্দুমোহন যে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, সেটা লক্ষ্মী কানাইয়ের বাপের মুখেই শুনেছে। পালিয়ে বিয়ে করে তো তারা দুজনে ওই নেলিতেই চলে গিয়েছিল। ঘরের অবস্থা ছিল চলনসই। বিয়ের পর টাকাপয়সা ভালোই আসছিল সংসারে। তিনি বলতেন, সত্যিই লক্ষ্মী এসেছে তাঁর ঘরে। কিন্তু একটা অ্যাক্সিডেন্টে সুধেন্দুমোহনের পা ভেঙে যাওয়ায় সব ওলটপালট হয়ে গেল।
বন্যার পর থেকে তো এখানেই। মাঝে চল্লিশটা দিন শুধু রিলিফ ক্যাম্পে কেটেছে। তাগিদ ছিল না কখনই। তবু একদিন দুজন দিদিমণি আর একজন মাস্টারমশাই এসে নাম-ধাম লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন। গতবার ভোটের সময় কানাইয়ের বাপ এসে বলেছিল, এবার ভোট দিতে যেতে হবে। কিন্তু ফিরে আসতে হয়েছিল ভোট না দিয়েই। সকাল থেকে লাইন দিয়ে ইসকুলের ভেতরে ঢোকার পর সাদা জামা পরা লোকটা জানিয়েছিল কানাইয়ের বাপ আর সে নাকি ডি-ভোটার! নামটা তারা প্রথম শুনেছিল। বাইরে দাঁড়ানো লাইনের অন্য লোকেরা বলেছিল, কোর্টে গিয়ে ব্যাপারটার ফয়সালা করে নিতেকিন্তু ওই পর্যন্তই। সুধেন্দুমোহনকে ব্যাপারটা এসে জানানোয় তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়েছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। কেউ বাড়িতে এলে তাদের জিজ্ঞাসা করে ব্যাপারটা ঠিক করা যায় কিভাবে, তা হয়ত ভেবেছিলেন – কাজের কাজ কিছু হয়নি।
সবকিছু শুনে আলতাফ লক্ষ্মীকে আশ্বাস দিয়েছিল, সে-ই তাকে নিয়ে গিয়েছিল শঙ্করনগরে। রবিন উকিল তামুল চিবোতে চিবোতে আর পিক ফেলতে ফেলতে যা বলল তার সারমর্ম হল ভোটার লিস্ট লাগবে তাও আবার একাত্তরের আগের। স্কুলের সার্টিফিকেট হলেও চলবে – মানে এমন কোন একটা সরকারি কাগজ, যা একাত্তরের আগের।
কানাইয়ের বাপের জন্মই হয়েছে আশি সনে আর তার বিরাশি – কেউই স্কুলের পড়া শেষ করেনি, তাই সার্টিফিকেটও নেই। লক্ষ্মীর বাবার কাছে কি কাগজ আছে তা জানা নেই, কিন্তু সুধেন্দুমোহনেরও তো নেই কিছু।
তবু তাঁর শেষ সম্বল পাঁচটা একশো টাকার নোট লক্ষ্মীর হাতে তিনি তুলে দিয়েছিলেন উকিলবাবুকে দেবার জন্য। আলতাফ সেখান থেকে একশো টাকার একটা নোট চেয়ে নিয়েছিল। সেজন্যই বোধহয় এবার জানা গেল যে, যমুনামুখের একটি কেন্দ্রে ১৯৫১ সালের ভোটার লিস্টে দুজন সুরেন ঘোষের নাম পাওয়া গেছে। তার একজনের পরিবারে সুধেন্দু, ভবেন্দু, রাধারানি ইত্যাদি নামগুলো আছে। রাধারানি ঠিক আছে কিন্তু ভবেন্দু কে?!! লক্ষ্মী জানে না। কিন্তু এবার এমন কাগজ চাই যেটাতে বোঝা যাবে যে এই সুরেন ঘোষই সুধেন্দুমোহনের বাবা সুরেন্দ্রমোহন। ফ্যাকড়া আরও আছে। দ্বিতীয় সুরেন ঘোষের ছেলে হিসাবে সুধেন্দ্র, বয়স ২২ লেখা রয়েছে। বয়সটা মিললেও সুধেন্দ্র আর সুধেন্দুতে পার্থক্য আছে। আগেরটাতে আবার বয়স মেলে না। অতয়েব কি করা?
মাত্র চারশ টাকায় এত কিছু বলা রবিন উকিলের বদান্যতা মাত্র – জানিয়েছিল আলতাফ, ‘শুনেন ভাবীউকিলের স্বভাবই ট্যাহা খাওন। এইভাবে আপনারে জুলুম দিয়া আরও কত পাশশ যে খাইব তার ঠিক নাইআমি কই কি, আপনে আমারে, .... মানে যদি বিশ্বাস করেন, .... এই ধরেন সব মিলাইয়া তিন ... না আড়াই  দিয়া দ্যান, তবে এক্কেরে পাক্কা কাগজ বানাইয়া দিমু, আমার লোক আসে ভিত্রে তারপরে তাগো মুখের উপর ছুইরা মাইরেন কাগজখান, দেইখেন লগে লগে দেবুরে ছাইড়া দিব।’  
লক্ষ্মী এতগুলো টাকা একসঙ্গে কোত্থেকে পাবে! সে হতাশ ভাবে আলতাফের দিকে তাকায়। আলতাফ আন্দাজে বোঝে ব্যাপারটা – ‘ কিসু ভাইবেন না ভাবী। দেশইত্যা ভাইয়ের লেইগ্যা এইটা যদি করতে না পারি তো কিসের বন্দু। কাম হয়ার আগে একহাজার দিবেন। বাকিটা পরে খেপে খেপে দিলেও অইব। আমি গিয়া নে নিয়া আমু।’ একটা ফিচেল হাসি তার লালচে দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে।
লক্ষ্মী ভয় পেয়ে কথাটা বসন্তের স্ত্রীকে জানিয়েছে। বসন্ত সেদিনই তাকে সাবধান করে দিয়েছে, ‘খবরদার দিদিভাই, আলতাফরে মানা কইরা দিবা। হ্যার কথার কোন ঠিক নাই...। আর শুন, দুইদিন আগে বিপিন সারে আইসিল, কইল এন.আর.সি হইব। এই মাসের তিরিশ তারিখের ভিতরে কাগজ লইয়া যাইতে হইব ইসকুলে। তোমার যখন সেইসব বালাই নাই তখন আমারা লগে চইল্লো – কছারি গাঁওবুড়ারে কইয়া একটা বিপিএল কাট বানাইয়া দিমু।’
লক্ষ্মীর মনে হল এই কার্ডে যদি কাজ হতো তবে শশুরমশাই বানাতে বলে দিতেন আগেই। তাই সে জানতে চায়, ‘রবিন উকিল তো কইসিল একাত্তরের আগের কাগজ লাগব, কানাইয়ের বাপগো বলে একান্ন সনের কাগজ আসে কোটে, আরও পাশশ ট্যাহা দিলে সেইটা বাইর কইরা দিব। কিন্তু অত ট্যাহা তো নাই। আলতাফরেও না করতে লাগব।’
বসন্তের স্ত্রী মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটে, ‘ওর কথা তুমি শুইনো না বইন। কাগজ যখন ওই উকিলে দিব কইসে তখন নতুন কাট বানাইবা ক্যান? হাওলাত কইরা হইলেও উকিলের ত্থিকা কাগজটা নিয়া আস।’
আরও হাওলাত!? লোকের বাড়িতে বিনে মাইনেতে খেটে দেবার কড়ারে শ্বশুরের কাজ তো তাকেই উতরে দিতে হয়েছে। সেটাও তো একরকম হাওলাত। তার নিজের ভাঁড়ার তো শূন্য। শ্রাদ্ধ আর লোক খাওয়ানো বাবদ বংশীর মুদির দোকানেও প্রায় ছশো টাকা বাকি। সেখানেও চাল বাছার কাজ করে শোধ দিতে হবে। হাতের কাজে তার সুনাম আছে বলেই টিঁকে আছে এখন পর্যন্ত।
লোকে বলে, লক্ষ্মীর হাতের ছোঁয়ায় জাদু আছে। কিন্তু সব হারিয়ে তার চারদিকে এখন অন্ধকার। এমন কোন জাদু তার জানা নেই যে কানাইয়ের বাপকে সে আগের মতো করে পাবে বা এন.আর.সি-র জন্য দরকারি কাগজটা সে এখুনি ছুমন্তর করে পেয়ে যাবে হাতের কাছে। সে জানে সবকিছুই সে হারিয়েছে। তার মন বলছে, অবস্থা বদলাচ্ছে – আগের মতো নিশ্চিন্তে আর থাকা যাবে না। সুধেন্দুমোহনের বয়স হয়েছিল, এমনিতেই হয়ত তিনি মারা যেতেন। অথচ হাওয়ায় ঊড়ছে, ছেলে-বউএর ডি-ভোটার হবার খবর তাঁর মরণ ডেকে এনেছে। কোনটা সত্যি আর কোনটাই যে মিথ্যে তা ঠাহর হয় না লক্ষ্মীর।
এরকম অবস্থায় নিজের লোক ভেবেই বসন্ত তাকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করে, ‘নাইলে একটা কাম করো দিদিভাই। বাপের কাসে ফিইরা যাও। যদি কোন সাহায্য তিনি করতে পারেন...... আর যদি কোন কাগজ পাও তো লইয়া আইতেও পারবা।’
হায় রে বাপের বাড়ি!! আজ কত বছর বাপের মুখ দেখেনি লক্ষ্মী! সেখানে এতদিন কী ঘটেছে, কে কোথায় কী করছে, কিছুই তার জানা নেই। মায়ের চুরি দুগাছা সম্বল করে পালিয়ে আসার পর আর যোগাযোগ করার সাহসও হয়নি। দু-একবার কানাইয়ের বাপ চেষ্টা করেছিল, বিশেষ করে কানাইয়ের জন্মের সময়। কিন্তু লোকমুখে বাপের রাগের কথা শুনে আর সাহস হয়নি। এখন কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে?
কিন্তু এদিকের খবরটাও তো দেওয়া দরকার। বসন্ত আর তার স্ত্রী তাকে বারবার একথাই বুঝিয়েছে। এখন তো আর কানাইয়ের বাপের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। সে ওই ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখদুটো দিয়ে শেষ মুহূর্তে কী বোঝাতে চেয়েছিল, লক্ষ্মী জানে না। হয়ত বলতে চেয়েছিল, ‘লক্ষ্মী, তুই পালা’ বা হয়ত বলতে চেয়েছিল, ‘তুই মর – ওরা তোরে বাইচা থাকতে দিব না।’
থানা থেকে এসে তাকে নিয়ে যাবার আগে লক্ষ্মী ঘটনার গভীরতা সম্পর্কে কোন আঁচ পায়নি। তাকে বলা হয়েছিল, দেবেন্দ্রকে ছেড়ে দেওয়া হবে – তাকে ফেরত নিয়ে আসার জন্যই লক্ষ্মীকে ক্যাম্পে যেতে হবে। কানাইদের বসন্ত সর্দারের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে সে প্রায় দৌড়েই চলে গিয়েছে ক্যাম্পে। বসন্তের স্ত্রীকে বলে আসার কথাও তখন মনে পড়েনি।
হ্যাঁ, কানাইয়ের বাপকে লক্ষ্মীই শনাক্ত করেছে। আগের রাতে সে নাকি সিলিং থেকে ঝুলে পড়েছিল।.....  
এখন রাস্তায় ঘষটাতে ঘষটাতে, বৃষ্টির ছাঁটে ভিজতে ভিজতে সে নিজেকে শনাক্ত করতে চাইছে।
--------------------

No comments:

Post a Comment

Note: only a member of this blog may post a comment.