দাহ্য
মূল—বিশ্বজ্যোতি দেব মহন্ত (ভাষান্তর – জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত)
সিঁদুরের কৌটোটা সে আলতো ভাবে হাতে তুলে নিল। বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে
ঢাকনাটা সামান্য ফাঁক করে কৌটোটা সাবধানে খুললো। এবার সে দেশলাই-কাঠির মাথায়
ঢাকনার চারপাশটা আস্তে আস্তে চেঁছে নিল। যাক বাবা! আজকের মতো সিঁদুরের কাজ শেষ। কাঠিটা নষ্ট করা যাবে না – মাথাটা
ভালো করে মুছে আবার বাক্সে ভরে রাখতে হবে। ওদিকে আবার চারালির লেবারগুলো কাজে
বেরনোর আগেই গরম গরম চা ‘রেডি’ রাখতে হবে। ভাঙা আয়নাটার সামনে সিঁদুর পরতে গিয়ে হঠাৎ
মনে হল ...... আয়নাতে আজ একজন নয়, তার মত দেখতে দুজন, দশজন বা বিশজন যেন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে
সিঁদুর পরছে।
আজ খুব গরম। চারালির কোণটায় সে অন্যদিনের মতই বসে পড়ল। ময়লা ন্যাকড়াটা দিয়ে ফিতেগুলো
টেনে স্টোভটা একবার নেড়ে দেখল – যা তেল আছে তাতে আজকের দিনটা চালানো যাবে। দেশলাই
কাঠিটা প্রথম ঘষায় জ্বলল না। ধুস, দিনের ‘কামাই’তে নজর লাগল নাকি!! ধ্যাৎ, তা কেন?
কাল সে বাটা দিয়ে আসবে। ভগবান কি আর মুখ তুলে চাইবেন না? যাক কাঠিটা জ্বলল! বাঃ কি
লালাভ আগুন! ঠিক তার মাথার সিঁদুরের মতোই।
আজ বেশ দেরিই হয়েছে। খদ্দের আসা শুরু হয়ে গেছে। স্টোভের আগুনটাও নিভু নিভু। আর
কত! স্টোভই তো গ্যাস তো আর নয়! এখানে আসার আগে সকালে এটাতে বাড়ির সবার জন্য ভাত
রাঁধা হয়েছে। সকালে ঘুম
থেকে উঠে তারা চা খায় না তাই – নইলে তো এ আরও গরম থাকত। এভাবে গত এক বছর ধরেই
স্টোভটা জ্বলছে। রাস্তার ধুলো লেগে সে ‘নোংরা’ হয়েছে। কতটা ‘নোংরা’? ...... সে
ভাবল। নাইট ডিউটির সেই পুলিশগুলোর জিভের চেয়েও নোংরা? ওদের আর কি বলবে সে! তারা তো
তার ছেলের বয়সীই। সেজন্যই তো সে বউটাকে সঙ্গে নিয়ে আসে না। সোমত্ত বউ, কার নজর পড়ে
কে জানে! তার চেয়ে যে কয় ঘরে সে ঠিকে কাজ খুঁজে নিয়েছে তাতে লেগে থাকলেই ভালো।
স্টোভের আঁচ বাড়িয়ে কেটলির মুখটা সে খুলে দেখল, চায়ের জল ফুটছে। ভাড়াবাড়িটিতে
এতক্ষণে হয়ত তার বউমা স্নানটান সেরে কাজে বেরনোর জন্য তৈরি হচ্ছে। ভাঙা আয়নাটার
সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধতে তার খুব একটা দেরি হয় না। তারপর একবার ব্লাউজের হুকগুলো ঠিকঠাক
আছে কি না দেখে আঁটোসাঁটো করে কাপড়টা গায়ে জড়িয়ে নেয়, ব্যস এটুকুই। মেয়েটার কাঁচা
বয়স, গড়ন ভালো। টগবগে
যৌবন, কেটলির ফুটন্ত জলের মতোই। আর সে! সে যেন এই স্টোভটাই – সারাক্ষণ জ্বলছে!! –
আর এভাবে জ্বলতে জ্বলতেই গত বছর শহিদ হওয়া একমাত্র ছেলেটার মতো হঠাৎ সেও একদিন
নিভে যাবে।
-----------------
No comments:
Post a Comment
Note: only a member of this blog may post a comment.