Friday, 15 December 2023

                                                        Published on September 2023
 

Thursday, 10 June 2021

গ্রন্থ আলোচনাঃ 'শেষ পাতে' - অভিজিৎ চক্রবর্তী

 

গ্রন্থ আলোচনা

অভিজিৎ উড়ের হাঁড়িশালে, শেষ পাতে...

জ্যো তি র্ম য় সে ন গু প্ত

উড়ে বামুনের হাতের রান্না খুব সুস্বাদু – কথাটা এই অভাজনের মুখের কথা নয়, যিনি একবার চেখেছেন তিনি শেষ পর্যন্ত খেয়ে মায় কলাপাতাটুকুও চাকুম-চুকুম চেটে তবে কোলছাড়া করেছেন। আর অভিজিৎ বামুনের রান্নার খবর আমরা অনেকদিন আগেই পেয়েছি। তবে কিনা উড়ে বামুনের সাধারণ মণ্ডামিঠাইতে মন ধরে না! মণ্ডামিঠাই বাঙালের জিনিস। আর এ-জিনিস যত টকে তত বকে। উড়িষ্যা-বঙ্গদেশ নানা রঙ্গে ভরে যখন এই অসম দেশে মিশে ছিল তখন কত পাত যে পড়ত দৈনিক, সে আর কহতব্য নয়সে প্রসঙ্গ সাময়িক কি চিরকেলে, তা রসিক সর্দারেরা ঘোষণা করবেন। কিন্তু এটা ঠিক, উড়ে বামুনের বিছানো পাতের শেষে না পৌঁছলে ভোজন পূর্ণ বা ভোজনে পুণ্য এক্কেবারে হয় না।

আপাতত এই জানি, শেষ পাতে দই না হলে জমে না। পণ্ডিতজনেরা মিষ্টি দইতে লকডাউন দিলেও টক দইকে লক-আপে পুরতে পারেননি। কিন্তু চতুর্থ বুদ্ধের আপ্যায়িত ভোজসভায় দইয়ের উদয়ন হলো না! নাকি ছাপা ভোজন তালিকা থেকে দইটা উঁইয়ের পেটে চলে গেল! বিশ্বাস হচ্ছে না যে দই নেপোতেই মেরেছে। দই তো ইমিউনিটি সিস্টেমকে শক্তিশালী করে, হজম শক্তি বাড়ায়, এমনকি হার্ট ভাল রাখার সঙ্গে সঙ্গে বিষণ্ণতা দূর করে চাপমুক্ত করে। তীব্র তামসিক মাছ-মাংসের এঁটোকাঁটাদের পাশে যদি টক দই পড়ল তো মনটা একেবারে সাদা ...... সাত্ত্বিক-সাত্ত্বিক হয়ে যায়। তা নয়, দিল আড়াই গণ্ডা রসগোল্লা!

সে ঠিক আছে – রসগোল্লার ডায়েটারি ফাইবার হজম শক্তি বাড়ায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, হার্ট ভালো রাখে, কিডনিতে পাথর জমতে দেয় না – এগুলো সব ঠিক আছে। কিন্তু সে তো গরম অবস্থায়! তন্বী মেয়ের কুরি থেকে বুড়িতে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগে, হোক না একটা বছরেরই পুরনো? এতদিনে টকে যাবার সম্ভাবনাটাই বেশি। এমনিতেই তো খাঁটি বাছতে বই উজাড়। তার ওপর সেয়ানা ঠাকুর যদি কলাপাতায় মাছের এঁটোকাঁটার পাশে দিব্য আড়াই গণ্ডা কবুতরের ডিমের মতো রূপবতী রসগোল্লার বাটিটা পাতের সীমান্তে রেখে ঈষৎ টকে যাওয়া মণ্ডামিঠাইগুলো ঠেলে দেন হাতের কাছে, তাহলে আর বলার কিছু থাকে না। তবে কাজের কথা হল, ঘরে-ঘরে পাতের খাবার না খেয়েই হার্ড ইমিউনিটি বাড়ছে, খেলে যে আরও বাড়বে সেদিকে খেয়াল নেই। মওকা বুঝে বিজ্ঞাপনী মশলায় চোবানো তেলেঝোলে ‘সড়া হুয়া’ মৎস্য-মাংসের ছিবড়ে পাতের কোনে রেখে দিবানিদ্রা বা নিশিবাসরে গা এলিয়ে দেবার আগে হজমি গোল্লা যদি পাওয়া যায়, মন্দ কী! অভিজিত ঠাকুরের হাতে হজমি গোল্লা হার্ট-কিডনি-মস্তিষ্কের দুঃখ দূরীকারক জারকরসে চোবানো, বইবেদিক ইমিউনিটি বুস্টার।       

জনান্তিকে বলে রাখি, রান্নাটা সে তার বাঁজখাই গলাসমেত ডাকসাইটে ঠাকুমার কাছ থেকেই শিখেছে। সবটাই ঢিমে আঁচে দমে রাঁধা। ঠাকুমার ঝুলিতে তো কম কিছু ছিল না – সেই ঝুলি হারালে অমন সুখের আসরে কি দিবা কি নিশি, বিষাদরসটাকে এসে কাত করে দিয়ে যায়। এপাশ-ওপাশ হতে গিয়ে আবার খুঁচিয়ে খুঁজি আত্মপরিচয় অংশটাজীবনস্মৃতির সরণি বেয়ে এই প্যান্ডেমিকের কোলে ‘গুডনাইট/সুইট ড্রিমস্’-কে পাশ কাটিয়ে বিনিদ্র রজনী কাটাই নিশিকুটুম্বের পথ চেয়ে – কখন সে আসে আর কখন তার হাতে সাঁড়াশি তুলে দেব যাতে সে বাড়ির একমাত্র জলের পাম্পটা খুলে নিয়ে বিক্রি করতে পারে। বাণিজ্যেই তো মা লক্ষ্মী বাস করেন। হেল্প তো তাকে করাই দরকার – বিশেষত বৎস যখন বলে, ‘চোরটাকে অনেকটা বাবার মতো দেখতে’। ভ্যাবলা মেরে দেখি গ্রামতুতো ভদুদা খোলা সাইকেলটা ব্যাগে পুরে ঠিকঠাক জোড়া লাগানোর জন্য চলে যান শহরে। মেসোটাও হয়েছে এমনি বাংলা প্রিয় যে – কখনও আমার দিবাস্বপ্ন চুরমার করে হাম্বারবে চিকেনপাখিকে ফ্রি টিটেনাস দিতে বলছে, কখনও ২২শে আইন ঝাড়ছে তো কখনও টেকনোস্যাভি হয়ে ‘ক্যাটিস’ বানাচ্ছে। ঠাকুমারই চেনা এইসব গাছগাছড়া থেকে মসলা ঝেড়ে চক্কোত্তি ঠাকুরের হেঁশেল সরগরম

আমাদের বামুন ঠাকুর কিন্তু দই বা মিস্টির চেয়ে খিচুড়ি-লাবড়াটাই বেশি পছন্দ করেন। তাই বলি, শব্দের চচ্চরিতে নুন-তৈলাক্ত অভিজিৎ ঠাকুরের রান্না শেষ পাতে না পড়ে বরং ইমিউনিটি প্রত্যাশী ‘আম’ পাঠকের প্রথম পাতেই পড়ুক। বাঙাল উইড়্যা আর অহইম্যা ভেদাভেদে ভোগদখল চলুক

  কভারের কলাপাতায় আটকে আছেন? যদি ইমিউনিটি বাড়াতে চান, এক্ষুনি অভিজিৎ চক্কোত্তির সঙ্গে শেষ পাতে বসে যান। প্রথমেই টকে যাওয়া মণ্ডামিঠাই দেখে ঘাবড়ে যাবেন নারকমারি পদে ভুরিভোজন হবে। এখনও যদি না বুঝে থাকেন তবে উইপোকা কাটার আগেই একশো টাকা দিয়ে ‘শেষ পাতে’ কিনে বসে পড়ুন।

----

Friday, 4 June 2021

গোট-সিনড্রোম বা টাইমপাসের কড়চা

গোট-সিনড্রোম বা টাইমপাসের কড়চা

জ্যো তি র্ম য়  সে ন গু প্ত

 

বি-ব্লকের সন্তোষদা একবার বলতে শুরু করলে আর কাউকে কোন চান্স দেন না, অনর্গল বকে যান। আর যে বিষয় বা যার সম্পর্কে বলা শুরু করবেন তার আখপেষা ছিবড়ে না বার করে থামবেন না, পরিবেশ অনুকূল হলে তো কথাই নেই। আর কেউ যদি প্রতিবাদ করে কোনো কথা বলেছি, ব্যাস পা-দুটো ছড়িয়ে হাতদুটোকে বুকের কাছে ভাঁজ করে থুতনিটাকে প্রায় সেখানে গুঁজে একেবারে থম মেরে বসে থাকবেন – নো নড়ন নট চড়ন। একেবারে ফ্রিজ শট। তিড়িংবিড়িং লাফানো ছাগল হঠাৎ যেমন হাত-পা শক্ত হয়ে পড়ে থাকে ঠিক সেরকম। গোঁসা ভাঙাতে কয়েকটা বড়ো ফিল্টার, দু-তিন কাপ গরম চা তৎসঙ্গে গরম শিঙাড়া খরচা হয়। তারপর তাঁর হাবেভাবে সাড় আসে। তবে আমরা পালা করে এটুকু খরচ সামলে নিই, কারণ অবসর বিনোদনের এত জমাটি সোর্স এই আবাসনে আর কোথায়! বুঝে গেছি, এটা তাঁর মজ্জাগত।

আড়ালে আমরা তাঁকে ডাকি অসন্তোষবাবু বলে, তিনি সেটা জানেন কি না জানি না। আর জানলেও বা কি, আবাসনের পার্কে কয়েকটা রবিবাসরীয় সান্ধ্য আড্ডায় তিনি আসবেন না। আবার একদিন ঠিক ফোন করবেন – ‘কিহে তালুকদার, হবে নাকি আজ?’ আপনি মিলিয়ে নেবেন, একটা না একটা মশলাদার খবর সন্তোষদার কাছে জমা পড়ে গেছে। গল্পের যেন অফুরন্ত ভাণ্ডার তাঁর কাছে, পারেনও হাঁড়ির খবর জোগাড় করতে। নানা রকম রঙচঙে খবরে এবং সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় তাঁর বেজায় শখ। আমরা যখন তাঁর এমন কোন মশলাদার খবরে কুপোকাত তখন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেই ফেলেন ‘আমারও একটা সিক্সথ সেন্স আছে হে। গন্ধ ঠিক নাকে এসে লাগে’।

 বেশিদিন হয়নি সন্তোষ হালদার এখানে এসে উঠেছেন। কাজ করতেন রেলের হেড অফিসে, পি.ডব্লু.ডি-তে এস.ও মানে সেকশন অফিসার হয়ে রিটায়ার করেছেন। রেল কোয়ার্টার ছেড়ে এখন এই আবাসনের স্থায়ী বাসিন্দা। ঘরের আসবাবপত্র দেখে মনে হয় বেশ কামিয়েছেন! গল্পে-গল্পে আমাদের শুনিয়েছিলেন, তাঁর বাবা নাকি সেই কবে ভাগলপুরের রতনলাল সুগার মিলে চাকরি পেয়েছিলেন, না গিয়ে এখানে চলে এসেছেন রেলের ওভারসিয়ার হয়েসেও আরেক গল্প। ওই যে পুরোনো সিনেমাটা, ‘এক আধুরি কহানি’ না কি যেন। আমরা ভেবেছিলাম ইমরান হাসমির ‘হামারি আধুরি কহানি’। বলি বলি করেও সন্তোষদা অসন্তুষ্ট হবেন ভেবে আর এগোতে সাহস করিনি। উনি জোর দিয়েই বলেছিলেন, সিনেমাটা নাকি তাঁর বাবার এক মাসতুতো দাদার গল্প নিয়েই তৈরি হয়েছিল। সিনেমার গল্প লিখিয়ে সুবোধ ঘোষ বেমালুম জ্যাঠামশাইয়ের গল্প মেরে দিয়েছেন। কোথায় ‘গোত্রান্তর’ আর কোথায় জ্যাঠামশাইয়ের সেই গায়ের লোম খাড়া করা হরতালের গল্প। জ্যাঠামশাই বেঁচে থাকলে ঠিক তাঁর মুখেই গল্পটা তিনি তাঁর এই চার ইয়ারকে শুনিয়ে দিতেন।

আবার একদিন ঋতুপর্ণকে নিয়ে পড়লেন। আমরা যতই বোঝাই, ‘আরে দাদা, ও হেনরির গিফট অফ দ্য ম্যাজাই থেকে গল্পটা নেওয়া হয়েছে, ঋতুপর্ণ বলেই দিয়েছেন।’ তবু টলানো যায় না তাঁকে। আমরাও শেষমেশ মেনেই নিলাম যে মনোজ বসুর ‘প্রতিহিংসা’ গল্পটাই আছে ‘নেমসেক’-এ। নাহলে হাল্কা শীতের সন্ধ্যায় পার্কের সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরটা বেশ গরম হয়েই উঠছিল। 

আজকেও, রিয়া চক্রবর্তী, সুশান্ত সিং, ড্রাগস-বলিউড-টলিউডের সনসনি তেজ গল্পগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পর আমরা যখন এন.আর.সি, অখিল গগৈ বা আসুর নতুন রাজনৈতিক দল হয়ে হাথরসে ঢুকব-ঢুকব করছি, ঠিক তখনই ছোটো মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে একতলার বাসিন্দা নিশীথদা মাথা নিচু করে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। গোনাগুনতি পাঁচ থেকে সাত সেকেন্ড, হয়তো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেও পারেননি, তখনই সন্তোষদার মুখ খুলে গেল – ‘দেখলে, তালুকদার দেখলে, কাণ্ডটা দেখলে। আমরা যে আছি এখানে, পাত্তাই দিল না! ভদ্রতা বলতে কিছুই নেই!! দেমাকে দেখছি মাটিতে পা পড়ে না।’

আমরা সবাই যে যার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে নিলাম – ‘আরে উনি বরাবরই একটু চুপচাপ গোছের। তবে নির্ভেজাল। লেখাটেখা নিয়ে থাকেন, মেয়েকে বোধয় টিউশন থেকে নিয়ে ফিরলেননাহার কথায় যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন সন্তোষদা, ‘আরে রাখো তোমার লেখাটেখা। কিছুদিন ধরেই লক্ষ করছি এই ওয়ান-এ-কে, দু-কলম লিখলই বা, পা একেবারে মাটিতেই পড়ে না? তুমি তার লেখার খোঁজ রেখেছ? ক’টা বই লিখেছে বা ক’টা পাবলিশার ওর পেছনে ঘুরঘুর করে, হাতে গুনে বলতে পারবে?’

এরপরই সন্তোষদা ঠোঁট উলটে বুড়ো আঙুলটা আমাদের সামনে একবার ঘুরিয়ে নিলেন, যার মানে হচ্ছে কাঁচকলা। তবে এই কাঁচকলাটাও বেশ অর্থবহ – এক, হতে পারে নাহা কিছুই জানেন না এ-বিষয়ে; দুই, এও হতে পারে যে নিশীথদার বিশেষ একটা এলেম নেই লেখালেখির লাইনেকিন্তু সন্তোষদা বেশ উত্তেজিত ভাবেই ধারাবিবরণী শুরু করে দিয়েছেন, ‘এ না কি লেখে – গপ্প, কবতে, নাটিকা সবি নাকি লেখে, কাগজে আবার ছাপায়ও!! কে পড়ে বাবা জানি না। লেখক হতে গেলে অরিজিনাল কলমের জোর দরকার। এরকম লেখক পাড়ার সেক্রেটারিকে ধরে-কয়ে দুগগো পুজোর স্যুভেনিরে কখনও একটা তিনপাতার লেখা বা বড়ো জোর একখানা দশ-বারো লাইনের কবিতা ছাপায় – দৌড় তো ওই পোজ্জন্তইআরে বাবা, কত্ত ওরকম রাইটার দেখলাম। সুনীল-সমরেশের কথা ভেবে তো লাভই নেই, আগে একটা প্রফুল্ল রায় কি নিমাই ভটচাজ হয়ে দেকাও দিকিনি! নিদেনপক্ষে একখানা সৌরভ চলিহা কি শীলভদ্র হতে পারলেও কথা ছিল।’

আমি বাধা দিলাম, ‘আহা, ছাড়ুন না। অন্যের ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করার দরকার কি? বরং হাথরসের ওই মণীষা মেয়েটার কথা কি বলছিলেন, সেটা শোনান।’

– ‘আরে বলছ কি তালুকদার, ওই ম্যাটারটাই তো ম্যাটার করছে। ইন্টারফেয়ার করা হবে কেন, জানতে চাওয়াটা দোষ? এই যে রিয়া চক্রবর্তী – আফটার অল বাঙালি তো, কিছু বলা যাবে না? বা এই যে রেপড মেয়েটা -- হয়তো মরেই যাবে, ইন্টারফেয়ার করা বললে তো এদের নিয়ে কথা বলাই চলে না, মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে হয়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে এই ম্যাটারগুলোতে যদি মন খুলে কথা না-ই বলতে পারি তো কীসের বাক স্বাধীনতা? আমি তো লম্বা করে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছি। প্রচুর লাইক মেরেছে সবাই।’

নাহা একটু খুঁচিয়ে দিল, ‘লাইক পেয়েই আপনি কাইত হয়ে গেলেন? ওরকম তো আমরা হাজারটা পাই। আপনার এই স্যোসাল কাপে ঝড় তুলে কী লাভটা হয়েছে বলুন তো? কিছু ঝাপটা ফেসবুকের বাইরে এসেছে নাকি ওখানেই নাইটফল হয়ে গেছে?’

সন্তোষদা মনে হলো ভাবছেন, বাউন্সারটা ডাক করবেন না খেলবেন চোখ সরু করে গলা নামিয়ে নাহাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ক্যাকোফোনি চেনো? কাকের কর্কশ গান?’ চক্রবর্তী শুধরে দিল, ‘ওটা কাকের গান নয়, বেসুরো ব্যাপার-স্যাপারকে বলে ক্যাকোফনি

– ‘একদম তাই। লাভালাভ দেখে স্যোসাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়াটা চরম সুবিধেবাদী ব্যাপার। এই যে তুমি পোস্ট দেওয়া নিয়ে বললে, সেটা ঠিক ওই কাকের গানের মতোই।’    – ‘বেশ, তাহলে হাথরসের সঙ্গে কাশ্মীরের মেয়েটির কথা আনুন, অর্ণমাই বরাকে আনুন, দুটো অরুণাচলি বাচ্চা কাজের মেয়েকে যে রেপ করল মালিকের ছেলে সে কথাটা বলুন, আরটিকাল ২১—হিউম্যান রাইট নিয়ে কথা বলুন!’

–‘তোমাদের এই এক রোগ, সবকিছু রেলিজিওন অ্যান্ড রিজিওনাল পলিটিকসে টার্ন করিয়ে দিতে চাও। আমি তোমাদের মতো কালারড পলিটিকসে বিশ্বাস করি না। ইন ফ্যাক্ট, কোন পলিটিকাল আইডেন্টিটি আমার নেই, আর তোমাদের এই ক্যাকফনিতে মাথা গলিয়ে সাধের রাজনৈতিক ভ্রমণ পিপাসু হবার কোন ইচ্ছেও নেইযখন যে বিষয়ে বলা উচিত মনে করি, সেটাই বলি। কোন পোস্ট ট্রুথে মাথা গলাই না।’

হো হো করে হেসে ফেলল চক্রবর্তী, ‘প্লিজ, সন্তোষদা চেপে যান। আর এগোলে নাহা এমন বল থ্রো করবে যে আপনি সাডেনলি আবার ফ্রিজ শট হয়ে যাবেন। আপনার তো আবার  মায়োটনিয়ার অভ্যেস আছে।’ আমরা সমস্বরে হেসে উঠলাম। কিন্তু সন্তোষদা মনে হল ক্ষেপে গেলেন,–‘মানে?!!’                                                                        – ‘মানে, মায়োটনিয়া কনজেনিটা, যাকে সোজা করলে দাঁড়ায় গোট সিনড্রোম। পোষা কুকুর-ছাগলকে দেখেছেন চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়তে?’ আমি খুলে বললাম।

সন্তোষদা জুৎসই জবাব দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু এবার রসে ভঙ্গ দিল নিশীথদার মেয়েটি। সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দার করে নেমে একেবারে সন্তোষদার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো, ‘জেঠু-জেঠু, একটা হেল্প করবে প্লিইজ...?’সন্তোষদা একটু থতমত, প্রথমটায় চুপ করে মুখ ঝুলিয়ে রাখলেন। আমরা বেশ উৎসাহিত, কীই বা হেল্প! মেয়েটি সন্তোষদার উত্তরের অপেক্ষা না করেই গড়গড় করে এক নাগাড়ে বলে গেল, ‘আমি না, অ্যানুয়াল ফাংশানে মিনি সাজব, তুমি আমাদের কাবুলিওলা হবে?’

‘অ্যাঁ’!!! – সন্তোষদা তিড়িং করে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। আমরা কেউ হাসি চাপতে পারলাম না। সন্তোষদা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি তোমার কাবুলি সাজব, এটা কার আইডিয়া শুনি?’

একদিকে আমরা হাসছি আর ক্ষেপে গেছেন সন্তোষদা – এই অবস্থায় মেয়েটি ঘাবড়ে গিয়ে ছোট্ট করে বলল, ‘বাবা’।   সন্তোষদা আবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা রবিঠাকুরের রোলটা কি তোমার বাবা করবে?’ বেচারি ঘাবড়ে গেল। এক দৌড়ে সে যেমন এসেছিল, তেমনই পালালো। চক্রবর্তী চেঁচিয়ে বলল, ‘মামনি, বাবাকে বলো আমরা ডাকছি, আর তোমার জেঠু ঠিক কাবুলি সাজবে।’

এই যাহ, সন্তোষদা আপনি আবাসনের কাবুলি হয়ে গেলেন!! – নাহা একটু খুঁচিয়ে দিল, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট নিয়ে ওর রাগটা তখনও পড়েনি। সন্তোষদা চুপ। আমরা ভাবছি একটা ফায়ার বল এলো বলে। এবার আবাসনে থার্টিফার্স্টের ফাংশনে সন্তোষদা রিসাইটেশন আর মূকাভিনয় করবেন, ঠিক হয়ে আছে। হঠাৎ শত্রুপক্ষের উটকো হামলা -- রিঅ্যাকশন কী হয়!

কিন্তু সন্তোষদা আমাদের অবাক করে বেশ শান্ত ভাবেই বললেন, ‘একটা জিনিস কি জানো, অভিনয় ব্যাপারটা আমাদের রক্তে মিশে আছে বড়ো বড়ো অ্যাক্টরের সঙ্গে তো আমাদের একরকম ফ্যামিলি রিলেশনই ছিল। তবে ওই মূকাভিনয়টা তাহলে আর করছি না, কি বলো? কাবুলিওয়ালাটা কিন্তু খুব চ্যালেঞ্জিং। মিতেজ্যাঠার অভিনয় তো এই দু-হাত দূর থেকে দেখা।’ আমরা তাঁর তর্জনী নির্দেশিত দুহাত দূরে তাকিয়ে অন্ধকারে বাউন্ডারির গায়ে দাঁড়ানো ইউক্যালিপটাসগুলোকেই দেখতে পেলাম।

নাহা আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। চক্রবর্তী হাতের ইশারায় তাকে চুপ করতে বলে সন্তোষদাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মিতেজ্যাঠা কে? এঁর কথা তো আগে শুনিনি!’ একগাল হেসে সন্তোষদা চক্রবর্তীর দিকে ঘুরলেন, ‘তোমরা আর কতটুকু জানবে। একটা সিগারেট হবে নাকি? তাহলে শোনাতে পারি  মিতেজ্যাঠার গল্প।’

বুঝলাম, আবার এক গল্পে পেয়েছে সন্তোষদাকে, আপাতত নিশীথদা বাদ। আমাদের সোসাইটির ক্যাসিয়ার অসীমবাবু পকেট থেকে উইলস ফিল্টারের প্যাকেটটা বার করে এগিয়ে দিলেন, চক্রবর্তী লাইটার। ‘স্যানিটাইজ করা আছে তো?’ সন্তোষদার প্রশ্ন, আবার নিজেই উত্তর বার করে নিলেন, ‘অবশ্য আগুনে কোন দোষ নেই’। তারপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে শুরু করলেন, ‘সেসব কি দিন গেছে! মা গান-বাজনা ভালোবাসতেন। ওই জ্যাঠামশাই ধরে ধরে আনতেন সব আর্টিস্টদের। একসঙ্গে ওঠাবসা ছিল তো। একবার কলকাতা থেকে নিয়ে এলেন মিতেজ্যাঠাকে।’

       চক্রবর্তীর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘মিতে জ্যাঠা কোলকাতার??!!’ – ‘আরে তোমাদের তো বলাই হয়নি, অবশ্য কতই বা আর বলব, লকডাউন বলেই না একটু আধটু বসে কথা বলতে পারছি। তা মিতেজ্যাঠা হল অজিতেশ ব্যানার্জী। নাম শুনেছ তো? জ্যাঠামশাইয়ের একেবারে ল্যাঙ্গোটিয়া দোস্ত, নেমসেক, বুঝলে না!! তো সেবার রেলের মাঠে বিশাল আয়োজনওঁর অভিনয় দেখার জন্য একেবারে লোক ভেঙে পড়েছিল। আমাকে তো বাড়িতে রিহার্সাল করার সময় ডেকে নিতেন। বলতেন, সতু তুমি আমার এই পার্টটা একটু করে দাও দেখি।.... আমি আবার ভুলটুল কিছু হলে ঠিক ধরতে পারতাম। তো, যে ক’দিন বাড়িতে ছিলেন আমাকে দিয়েই ভুলগুলো শুধরে নিতেন।’

‘ভুলগুলো শুধরে নিতেন ওঁকে দিয়ে????!!!’ -- আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। অসীমবাবু জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, ‘আপনি নাটক করতেন!’- সন্তোষদা থেমে গিয়ে,  যেন ওটা বাঁ-হাতের খেল, এমন ভাবে বললেন, ‘ওই একটু আধটু আর কি। রেলের কম্পিটিশনগুলোতে আমাকে ছাড়া তো চলতই না। ডিরেকটর কাম দলের ম্যানেজার....।’

আমি অনেকক্ষণ ধরেই সুযোগ খুঁজছিলাম। সন্তোষদা একটু থামতেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘তাহলে নিশীথদাকে নিয়ে আপনার আর কোনো অবলিগেশন নেই, ওঁর মেয়ের সঙ্গে আপনি কাবুলিওয়ালার ভূমিকায় অভিনয় করছেন এবার?’ চক্রবর্তী ফোড়ন কাটল, ‘ইসস আগে জানলে আপনাকে একক অভিনয় করতে বলতাম। এক কাজ করুন, নিশীথদার সঙ্গে জয়েন্টলি কবিতার অন্ত্যাকশরী করুন। রিসাইটেশন পর্বটা জমবে ভালো।’

চোখ কটমট করে সন্তোষদা চক্রবর্তীর দিকে ঘুরে বসলেন, রেগে গেলে উনি সবাইকে ‘আপনি’ সম্বোধন করেন, ‘কখখনো নাওসব এলেবেলে প্রোগ্রামে মুড নষ্ট করে লাভ আছে কিছু? ভালো সুরেলা গান শুনলাম কি দুটো বাচ্চার নাচ দেখলাম কি গুণী মানুষের দুটো ভালো ভালো কথা শুনলাম – এপর্যন্ত ঠিক আছে। এমনকি ধরুন ওই যে আপনারা লিটল ম্যাগাজিনের প্রদর্শনী করবেন বলে ঠিক করেছেন, সেটাও মন্দ নয়। কিন্তু ফাংশানে যার তার সঙ্গে আমায় বসাবেন না। সন্তোষ হালদারের একটা ইয়ে আছে।’

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাবুলিওয়ালার রোলটা?’ – ‘সেটা সময় এলে দেখা যাবে’ – সন্তোষদা আবার ফ্রিজ, স্পিকটি নট।  মরিয়া হয়েই বললাম, ‘নিশীথদাও কিন্তু নাম করেছেন।’ আবার সন্তোষদার বম্বিং – ‘হ্যাঁ করেছেন। ওই যে বললাম, একে তাকে ধরে রাইটার হয়েছেন।’

নাহা, চক্রবর্তী – দুজনেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘সন্তোষদা, আপনি কিছুই জানেন না। নিশীথদার লেখক হিসেবে নাম-ডাক আছে। ওই যে, আপনি আগে কাদের কথাটথা শুনে বলতেন, এখানে একজনই কবি আছেন – সেগুলো যারা বলে, তারা হয়তো ওঁর লেখা না পড়েই বলে। এই তো এবছরই একটা কবিতার বই বেরোল কোলকাতার পাবলিকেশন থেকে। আমাদের কাগজে এবার ‘দেশের কবিতায় বিদেশের গন্ধ’ শিরোনামে একটা দারুণ প্রবন্ধ লিখেছেন। ’

সন্তোষদা দমবার পাত্র নন, তাঁর যুক্তি – পকেটের পয়সা খরচ করে অমন বই অনেকেই ছাপায়,‘পড়ে কজন? ও আপনারাই পড়েন আপনারাই বোঝেন, আপনারাই পিঠ চাপড়ান। জোর করলে আমাকেও হয়তো কখনও বলতে হবে আপনাদের এই নিশীথ ভটের লেখা দুর্দান্ত, .... জাস্ট ছুঁয়েও দেখব না ওসব ছাইভস্ম।’

‘আপনি পড়েছেন ওঁর লেখা’ – চক্রবর্তীর প্রশ্নের জবাবে সন্তোষদা অম্লান বদনে মাথা হেলান

 – ‘কোনটা?’ – এবার নাহা

– ‘গত মাসে ‘ছুটির জানালা’তে বেরোল যে, আমাকে তালুকদারই তো পড়তে দিয়েছিলে, নক্ষত্র পতন না কি যেন!’

হ্যাঁ, আমিই সন্তোষদাকে গতমাসে দিয়েছিলাম কাগজটা, সঙ্গে নিশীথদার সদ্য বেরোন কবিতা বইয়ের একটা কপিও – নিশীথদা রেখে গিয়েছিলেন ‘শতভিষা ঝরে পড়ছে’র কয়েকটা কপি। পড়ে আমি বেশ চমকে গিয়েছিলামসন্তোষদা সেটার কথাই বলছেন, ‘আরে ওই যে আত্মপরিচয় খুঁজছে একটি মেয়ে, পরে রাস্তায় বাপকে দেখল মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, ভাইকে দেখল শ্রমিকের সঙ্গে হাঁটছে, মাকে দেখল লালকেল্লার চূড়োয়.... ব্যাস হয়ে গেল। এগুলোকে কবিতা বলেন আপনারা!! কি বলো ভায়া?’

আমি একটু অবাকই হলাম, নাহা আর চক্রবর্তীরও একই অবস্থা, ‘নক্ষত্র পতন!! এ-নামে কোন কবিতা নিশীথদা লিখেছেন? তালুকদার ???’ – প্রশ্নটা আমার দিকে উড়ে এলো।

অতএব আমাকে বলতেই হলো, ‘না, সন্তোষদা, আপনার বোধহয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আপনাকে তো দিলাম পড়তে, দুদিন পর ফেরতও দিলেন, বললেন ভালোই লেগেছে। বইটাও বললেন, প্রচ্ছদ খুব সুন্দর হয়েছে – কবিতাগুলোও ভালো! কিন্তু এ নামে তো নিশীথদার কোন কবিতা নেই, ছুটির জানালাতেও নয়। আর আমি তো আপনাকে দিলাম ‘সকালবেলা’র রবিবাসরীয়! আপনি ‘ছুটির জানালা’ পেলেন কোথায়?’

– ‘যেটাই হোক। কবিতা হওয়া নিয়ে তো কথা? কবিতাই হয়নি। কোথায় সেই ‘ছিপখান তিন দাঁড়’ বা ‘পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি’র মতো ছন্দ, ভাব -- আর কোথায় আপনাদের এই নিশীথ ভটের কবতা! শুধু বাঃ দারুণ বলে পিঠ চাপড়ে দিলেই হলো? কোয়ার্টার ছেড়ে আসার সময় কত্ত বই ম্যাগাজিন সব বিক্রি করে দিয়ে এসেছি। দেখলে বুঝতেন। ভালো ভালো লেখা পড়ে আমাদের টেস্ট তৈরি হয়েছে, এমনি এমনি নয়ওরকম দেশের কবিতায় বিদেশ আমিও দুচারখানা লিখে দিতে পারি। নেহাত ভদ্রতার খাতিরে বলতে হয় তাই হয়তো সেদিন বলে ফেলেছি....

‘লে বাবা!’, চক্রবর্তী এবার একটু রেগেই গেল, ‘সন্তোষদা, আপনি যাই বলুন। নিশীথদাকে কিন্তু এভাবে ফেলে দিতে পারবেন না। শুধু লেগ পুলিং করে গেলে কিন্তু কোন লাভ হবে না।’

–‘তা হোক না চক্কোত্তি, আমার তাতে কিছু এসে যায় না। যা সত্যি তা সবসময়েই সত্যি, মিথ্যেকারের সত্যি নয়, ট্রুথ মিন্স ট্রুথ। আগে দশটা লোকে বলুক, লোকে বই কেনার জন্য ভিড় জমাক দোকানে, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য হোক, তারপর নাহয় বুঝে নেব। কথায় বলে ‘আপনারে বড়ো বলে বড়ো সেই নয়’, দশজনে যতক্ষণ না বলছে ততক্ষণ কেউ আর কেউকেটা নয়। আপনাদের নিশীথবাবুও নয়, সে আপনারা যতই চেঁচান’

নাহা রেগে কাঁই, সন্তোষদাকে চার্জ করল সোজাসুজি – ‘ট্রুথ! মাই ফুট। ওটা আপনারই বানানো ফলস ট্রুথের স্যাম্পল। আপনি জানেন, নিশীথদার কবিতা নিয়ে যাদবপুরের কম্পারেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজের ছেলেমেয়েরা ওয়ার্কশপ করেছে গত জুন মাসে? জানেন ‘অবভাসিত’র কবিতাগুলো উনি দেখে না দিলে সম্পাদক ছাপান না?’

--‘না , জানি না।’

– ‘তাহলে শুধু শুধু অপবাদ দিচ্ছেন কেন? আপনি দেখান যে এখানকার সাহিত্য জগতের অনেক খবরই রাখেন, আসলে পড়েননি প্রায় কিছুই। কয়েকজন নামকরা ছাড়া এদিককার লেখা পড়া তো দূর ছুঁয়ে দেখার সুযোগ আপনার হয়েছে কি না সন্দেহ। নামকরাদেরও বা ক’টা গল্প-কবিতা পড়েছেন, সন্দেহ আছে। বাংলা কবিতার এক নম্বর লিটল ম্যাগাজিন ‘অবভাসিত’র নামই শোনেননি। অথচ বারফট্টাইটা ঠিক আছে। এরপর আবার বলে না বসেন মার্ক্স, ফ্রয়েড, কাফকা, বাখতিন মায় স্যসুর পর্যন্ত সব আপনার রক্তে আছে, আর তাই কয়েকজন ছাড়া বাকিরা এখানে লিখতেই জানে না।’

নাহা শেষ করার আগেই সন্তোষদা উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, হাত নেড়ে নাহাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ কথাটা শোনার পর তাঁর চোখমুখের ভাব বদলে গেল, একরোখা ভাবে তিনি গলা চড়ালেন, ‘যে লিখতে জানে না তাকে লেখক সাজানোর জন্য আমার কোন দায় পড়েনি, ভুলভাল কিছু বলিনি আমি। আর কথায় কথায় অত স্যসুর-শাশুড়ি-বাখতিন কপচাবেন না তো। ওই যে বলে না সফরী ফরফরায়তে, আপনার হয়েছে সেই দশা।’

নাহাও কম যায় না। সেও গলা উঁচিয়ে সন্তোষদাকে জবাব দিল, ‘নিশীথদা সামনে নেই, ওঁর লেখাও আপনার পড়া নেই, কারও একটা শোনা কথায় শান দিয়ে আপনিই সফরীর মতো ফরফর করছেন। ওঁর সামনে দাঁড়ানোর সাহস হবে না আপনার মতো ট্রুথ বিল্ডারেরসত্যিকার পাঠকের কাছে ওঁর লেখার কদর আছে, বুঝলেন?’

অসীমবাবু অনেকক্ষণ ধরে কথাবার্তা শুনছিলেন, খানিকটা বিরক্ত ভাবেই। এবার তিনিও উঠে দাঁড়ালেন, ‘শুধু শুধু নিজেদের মধ্যে একটা অদরকারি ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা করতাছেন। এই লকডাউনের সময় আপনারা কাজিয়া শুরু করছেন কে কি নয় তাই নিয়া। কই থারটিফাস্টের প্রোগ্রাম নিয়া আলোচনা করবেন, না এখন নিশীথবাবুকে নিয়া পড়সেন। এদিকে জিনিসপত্রের দাম যে হুহু করে বাড়তাছে তা দ্যাখছেন? আজকেও তেল কিনলাম প্যাকেটে আগের রেটের থিক্যা একুশ টাকা বেশি, হোলসেলে দাম বাড়াইয়া দিছে। ডেটল মারকেটে সাপ্লাই নাইজামাইয়ের প্রাইভেট ফারমের চাকরি খাইয়া নিছে মালিকে, মেয়ের মুখ চাইয়া ওরে এইখানে আমার দোকানে বসাইছিরাস্তার ওইপাশে প্রায় সব বাড়িতে করোনা ধরা পড়ছে। মানুষ বাঁচে কিনা ঠিক নাই, গরিবগুলানের  মুখে দুমুঠো তুইল্যা দেওয়ার কেউ নাই, যে পারছে সে সবজি বা মাছ ব্যাচতে বইয়া গ্যাছে। অতগুলা লেবার সেইদিন ঘুমের মইধ্যে মইরা গেল চাক্কার তলায়, আর আপনারা কাজিয়া করছেন নিশীথবাবুর লেখালেখি নিয়া ধুত্তারিকা!’  কথাগুলো বলে তিনি রাগটা চেয়ারের ওপর ঝেড়ে আড্ডা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন

আমরা সবাই চুপ, ঠিকই তো – এই মুহূর্তে আমাদের কাছে অদরকারি ব্যাপারটাই বড্ড দরকারি হয়ে পড়েছেকরার কিছু না থাকলেও চেল্লাবো। কিন্তু সন্তোষদা গরগর করেই চলেছেন, ‘কাজিয়া আমি করি না, লকডাউন তো সরকারি ম্যাটার, আমার একার ব্যাপার তো না, করোনা-টরোনা এগুলো গভমেন্টের দেখাই তো উচিত,  আর আমার অত সময়ও নেই অহেতুক বাজে কথায় নাক গলাবার

চক্রবর্তী তাঁকে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু চুপ করে গেল। অন্ধকারে আমাদের পেছন থেকে তখনই একটা গম্ভীর স্বর ভেসে এলো, ‘অথচ ঠিক সেই কাজটা করেই সময় কাটাচ্ছেন এতক্ষণ ধরে।.....’

আমরা চকিতে খেয়াল করলাম, আধো অন্ধকারে একটা ঋজু মানুষের ছায়া—নিশীথদা!! মাস্কটাকে থুতনি থেকে ওপরে টেনে নাক পর্যন্ত ঢেকে নিলাম চট করেসন্তোষদাও দেখছি তড়িঘড়ি স্ট্যাচু হয়ে গেছেন।

--------

 

 

Thursday, 3 June 2021

অথ সাইকেল কথা

 অথ সাইকেল কথা -- কুঁড়ি পর্ব     

     ছোট্ট লাল ট্রাইসাইকেলের ওপর আমার চিরদিনের আকর্ষণ। সেই বালকবেলাতেই সামনের বাড়ির তিন ভাইবোনকে পালা করে ট্রাইসাইকেল চড়তে দেখে আমারও ইচ্ছে হতো। কিন্তু ওপরওয়ালা যে তখন থেকেই আমাকে ঔপনিষদিক করে রাখবেন, কে জানত! 'তেন ত্যক্তেন' -- পাচ্ছি না, অতয়েব ইচ্ছে এবং আশা ত্যাগই একমাত্র পন্থা। কতদিন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেছি -- ওদের বাড়ির বড়ো দিদিটি একটু হাল ছাড়তেই ছোটো বোনটিকে ঠেলে নিয়ে যাবার দায়িত্ব পেয়ে বর্তে গেছি। মমেতি ন মমেতি চ-- হোক না সামনের বাড়ির সাইকেল, তবু ঠেলে ঠেলে খেললাম তো! 

    রেলশহরে তখন কেরোসিন শব্দটাই পরিচিত -- একটা বড়ো ট্রাইসাইকেলের ওপর তেলের ড্রাম শুইয়ে বাবুল, সখারাম, সুবামনিরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরত। যখন যে পাড়ায় তখন সে পাড়ার 'আমরা' পিছু পিছু ঘুরতাম, কী এক আকর্ষণে! আরেকটা ভদ্রগোছের ট্রাইসাইকেল ছিল -- একদিন জানলাম, তাকে বলে রিক্সা, বন্ধুদের কেউ কেউ বলত 'রিসকা'। দুটোর মাঝে কোনটা বেশি কেতাদুরস্ত, তা বুঝতে পারতাম না। তবে প্রতিভা দিদিমনি একদিন আচ্ছা করে কান মলে বইয়ের ছবিতে আমার সরু সরু মোলায়েম তর্জনি চেপে ধরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ওটা রিসকা নয় রিক্সা। তা কোনদিনই রেলশহরের বাবু আর অসুস্থ রোগীদের জন্য বরাদ্দ রিক্সায় চাপিনি, বরং বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাইসাইকেলে চাপার আকাঙ্ক্ষা চাগিয়ে উঠছিল। 

    বাবার একখানা হারকিউলিস সাইকেল ছিল, শুধু বাবার কেন -- হাতে গোনা দু-একজন বাদে রেলপাড়ায় সবারই ছিল -- অফিস যাবার জন্য। কালো রঙটা বেশি থাকলেও কিছুদিন পর র‍্যালের সবুজও এসে গেল। রাতের বেলা পেছন থেকে রেডিয়ামের লাল আলোটা স্বপ্নের মায়াজাল বুনত। স্ট্যাটাস অনুযায়ী সাইকেলের সাজসজ্জাও কম হতো না। পেছনের ক্যারিয়ার তো সবারই ছিল। কিন্তু সামনের বাস্কেট, পেছনের চাকায় লক সিস্টেম, ফুল চেন-কভার বা ব্যাটারি চালিত হেড লাইট সবার পোষাত না। আর ছিল সিট-কভার ও বাহার রঙের হাতল-ঢাকনা। বেশ নরম নরম সিট-কভারের দামটা একটু বেশি তিরিশ-চল্লিশ, হাতল পনেরো। টিং টিং বেলের বদলে একসময় ব্যাটারি চালিত পিঁপিঁ হর্নও বাজারে বেরিয়েছিল। তবে আমার সাবেক বেলের আওয়াজটাই ছিল বেশি পছন্দের। মুচড়িয়ে মুচড়িয়ে তার সবচেয়ে সুন্দর শব্দটা বার করাটা ছিল একটা দারুণ ইঞ্জিনিয়ারিং গেম। আওয়াজ শুনেই বলতে পারতাম কোনটা পেতলের আর কোনটা স্টিলের বেল। বেলের আকারও ছিল নানা রকম -- সেই অনুযায়ী আওয়াজেরও রকমফের হতো। বাবারটা ছিল পেতলের -- বড়ো, মিহি টিংটিং নয় বেশ ভারি গলায় টেংটেং করত -- মেসোরটা আবার র‍্যালে, ওই স্টিলের টিংটিং -- দেখতেও তন্বী। দুপুরে বাবা যখন লাঞ্চের জন্য বাড়ি ফিরে স্ট্যান্ডের ওপর সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে ঘরে ঢুকতেন তখন আমার কাজ ছিল খুব জোরে জোরে হাত দিয়ে প্যাডেল ঘোরানো। তখনই শিখলাম -- চেন পড়ে গেলে কীভাবে আবার প্যাডেলের দাঁতে তাকে আটকে দিয়ে একবার ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে আরেকবার সোজাদিকে আগুপিছু করে পরাতে হয়, হঠাৎ পড়ে গিয়ে হ্যান্ডেলটা বেঁকে গেলে কীভাবে দুপায়ের মধ্যে সামনের চাকাটা চেপে রেখে দুহাত দিয়ে তাকে স্বস্থানে আনতে হয়, টাইরডের মাঝ বরাবর ইংরেজি 'H' অক্ষরে খোদাই করা স্টিলের পাতটারই বা কী মাহাত্ম্য। তখনও কিন্তু সাইকেল চড়া শিখিনি। 

    ক্লাস সিক্সে ওঠার আনন্দে (প্রতিভা দিদিমণির হাত থেকে বাঁচার আনন্দটাও এর মধ্যে লুকিয়ে ছিল কি না আজ মনে করতে পারছি না) অফিস ফেরত বিকেলে আব্দার করলাম আর বাবা আমাকে সিটে বসালেন। কিছুক্ষণ পেছনে ধরে ধরে তিনি ছেলেকে ঠেলে নিয়ে চললেন। এভাবে ফাঁকে ফাঁকে চলল কিছুদিন। সামনের, পাশের, অল্প দূরের মিঠু-পাপন-তপুরা ততদিনে হাফ-প্যাডেলে সাইকেল চালাতে শিখে গেছে। আমার আবার ওটা আসত না -- মারি তো গণ্ডার আর কি! কিন্তু প্যাডেল ঘোরাতে পারি না, ঘোরাতে গেলে আর প্যাডেলে পা পড়ে না। দু-একবার ধপাস হলাম। বাবা বললেন, 'আস্তে আস্তে শিখবি'। কিন্তু আমার তখন ট্রাই সাইকেল না পাওয়ার শোক মেটানোর তাড়া। তাই শতবার চেষ্টা করার বেদতুল্য বাক্যের ধারকাছ দিয়েও গেলাম না। পাড়ার রাস্তাটা ছিল ঢালের মতো -- বাবার অগোচরে ঠেলে ঠেলে সাইকেলটাকে নিয়ে যেতাম ঢালের ঠিক মাথায় চন্দকাকুদের বাড়ির কালভার্টের সামনে, হাতের ঠেকনায় কোনোক্রমে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ডান দিক দিয়ে উঠতাম কালভার্টের ওপরে -- এবার স্বচ্ছন্দে সিটে বসে প্যাডেলে চাপ দেওয়া যাচ্ছে -- ব্যাস, সামান্য একটু চাপ -- তারপর তো গড়গড়িয়ে সোজা মজুমদার কাকুদের পাশে খোলা জায়গাটায় নেমে যাওয়া যায়। ওই খোলা জায়গার প্রতিটি ইঞ্চি আমার চেনা, ফুটবল-ক্রিকেট-দাড়িবান্ধা (মানে খো-খো)-ডাংগুলি-দড়ি টানাটানি-সন্ধের ব্যাডমিন্টন বা নিছক আড্ডা -- সবই চলত সেখানে। তাই এবার বাঁ-দিক ঘেঁষে কোনো একটা উঁচু জায়গার পাশে ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে পড়া -- এভাবেই বেশ কয়েকবার চক্কর চলত সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসা ইস্তক। মাঝে মাঝে দুপুরে বাবা খেতে এলে তখনও দু-একবার এভাবে প্র্যাকটিস করে নিতাম। আর এভাবেই সাইকেল চড়ার প্রাথমিক পর্বটা শেষ হলো।

অথ সাইকেল কথা -- পাপড়ি মেলার পর্ব     

    একটা বড়ো কথা হলো, নতুন কিছু শিখতে হলে নিজের আগ্রহ চাই -- নাহলে আকর্ষণ তৈরি হয় না। আর আমার সাইকেল শেখার আগ্রহ এতটাই তীব্র ছিল যে খুব শিগগিরই বাবার সাইকেল ছেড়ে মেসোর সাইকেলের প্রতিও আকর্ষণ তৈরি হয়ে গেল। বাবার সাইকেলটা ফি-বিকেল পেতাম না, অফিস থেকে ফিরতে দেরি হতো -- কখনও ব্যাডমিন্টন প্র্যাকটিস সেরে রাতে বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু আমার তো পরাণ জ্বলিয়া যায় -- পাপন-তপু বা ওদিকের মানস-শোভন (আমরা ডাকতাম সুবোন) বা বাদল -- কেউই তাদের বাব-দাদাদের সাইকেল ছুঁতে দেবে না। অতএব গুটিগুটি পায়ে একদিন গেলাম মেসোদের রেল কোয়ার্টারে। মেসো চাকরি করতেন হর্টিকালচারে, অফিসের জিপগাড়ি এসে নিয়ে যেত। জঙ্গলে পরিবার নিয়ে থাকা যায় না, তাই একটা কোয়ার্টার ভাড়া নিয়ে ছিলেন। সাইকেলটা পড়েই থাকত, ছুটির দিন আর রবিবার ছাড়া তার বিশেষ ব্যবহারও ছিল না, তাই বেশ চকচকে -- অন্তত আমাদের হারকিউলিসের চেয়ে একটু তো দেখতে ভালোই। প্রথম একদিন মেসোকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'চালাতে দেবে?' মেসো একদম সাবধান করে দিয়ে বললেন, 'পা-টা ভাঙব। তোর মা আমারে বইক্কা সিধা কইরা দিব। কাম নাই।' ভাগ্যিস মাসি সামনে ছিলেন না, নইলে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন কোনোদিনই হতো না, আবার সেই তেন ত্যক্তেন করতে হতো।

    কথায় বলে অধ্যবসায়ের দাম আছে। তা সুযোগ একদিন মিলে গেল। তখন ক্লাস সেভেন -- বাবার দেখাদেখি আমিও ব্যাডমিন্টন খেলায় যোগ দিয়েছি -- রেলের খেলোয়াড় প্র্যাকটিস করান বিকেল চারটা থেকে। একদিন তিনটের সময় মাসির কাছে গেলাম -- নেই, কালিবাড়ি গেছেন দিদির সঙ্গে দেখা করতে। হলো না। দুদিন পরে আবার, -- না এবারেও পেলাম না -- 'মেসো বকবো। তুই যদি হাত-পা ভাঙ্গস। আমার ভয় করে। মেসোরে কইয়া নিস।' ব্যাস, হয়ে গেলো। আমি তো জানি মেসোর উত্তর কী হবে! এর কয়েকদিন পরে এমনিতেই গিয়েছি মাসির বাড়ি -- মাসি বললেন, 'আমারে বৃহস্পতিবারের পান আর কলা আইন্যা দিবি? তোর মেসোরে কইতে একদম ভুইল্যা গেলাম।' আমি তিনপায়ে খাড়া, মানে রাজি,--'তাইলে সাইকেলটা দাও, আমার নিউ কলোনি নোট আনতে যাইতে হইব। তার আগে আইন্যা দিই।' (আহা কি সুবোধ বালক!!) মাসি চাবিটা হাতে দিতেই মনে হলো স্বর্গ এরেই কয়। ততদিনে হারকিউলিসের সিটে বসে এক অদ্ভুত ইনোভেশনে প্যাডেল ঘোরানো শিখে গিয়েছি। উঠেই ডান পা দিয়ে বেশ জোরে প্যাডেলে চাপ দিতাম, সেটা ঘুরে বাঁ-পায়ের নাগাল পেতেই আবার বাঁ-পা দিয়ে জোর চাপ। ব্যাস সাইকেল চলতে শুরু করল, আর ঠেলাঠেলির প্রয়োজন নেই। অতএব মেসোর সাইকেল পেয়ে প্রায় প্রত্যেকটা পাড়ায় চক্কর মেরে মিনিট কুড়ি পরে পান-কলা এনে দিলাম। আমিও খুসি, মাসিও।

    ঠিক এর পরের শনিবার বিকেল পোনে চারটায় মাসির বাড়ি হানা দিলাম -- 'মাসি সাইকেলের চাবিটা দাও না। আমার প্র্যাকটিসের দেরি হইয়া যাইতাসে, বকা খাইতে লাগব।' কনফিডেন্ট মাসি শুধু একটা কথাই বললেন, 'মেসো সন্ধ্যার সময় আইব, তার আগেই আইস্যা পড়িস।' সন্ধে কেন, তার অনেক আগেই ফিরে এসে সাইকেল যথাস্থানে রেখে চুপি চুপি চলে এসেছিলাম। যা ভয় পেয়েছিলাম, এরপর আর কোনোদিন মেসোর সাইকেল নিইনি। 

    আসাম মেল, আমাদের জনপ্রিয় ট্রেন, আর ছিল কামরূপ এক্সপ্রেস। এছাড়া ছিল পাহাড় লাইনের ট্রেন। আজ মনে নেই, এর মধ্যে একটা আসত দুপুর বেলা, লেট করলে বিকেল হতো। সেদিন বোধহয় লেট করেই একটা ট্রেন ঢুকেছিল স্টেশনে। আমি তখন প্র্যাকটিস শেষ করে ফিরছি। সঙ্গে মেসোর সাইকেল। একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো ব্যাপার, একটু ভয়ও আছে -- যেন কিছু না হয়। তখনও তো পুরো এক্সপার্ট হয়ে উঠিনি। 

    তো ওভারব্রিজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত সাইকেলটাকে হাঁটিয়েই নিলাম। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এরপর রেলিঙে হেলান দিয়ে প্রথম শেখা কায়দায় সাইকেলে চড়লাম। কেননা নতুন জায়গা, সাইকেল নিয়ে প্রথম দিন প্র্যাকটিসে গেছি -- তায় মেসোর সাইকেল, বাড়িতেও জানে না। অতএব সাবধানের মার নেই ভেবে সদ্য অতীত কায়দায় সাইকেলারোহন করলাম এবং যথারীতি প্যাডেলে চাপ দিয়ে এগোলাম। রেলওয়ে স্কুলের দাদা-দিদিরা তখন স্কুল থেকে বেরোচ্ছে। আমার একটু 'গব্বো'ই হলো। এদিক ওদিক চোখ ঘোরাতে গিয়ে হ্যান্ডেল্টা বড্ড বেশি এবাঁক-ওবাঁক নিচ্ছে -- তখনও তো ব্যালেন্সএ সড়গড় হইনি! যাহোক, কোনক্রমে স্কুলের গেট পেরোলাম। এবার রাস্তাটা একটু ওপরের দিকে উঠেছে, রেল-নাগরিকের ভাষায় 'আপ'। এখানে প্যাডেলে একটু বেশি চাপ দিতে হয়, তার ওপর ক্রমাগত বেল দিতে হচ্ছে। নাহ আর টাল সামলানো গেল না। শুধু দেখলাম, সাদা প্যান্ট পড়া দুটো পায়ের ভেতর দিয়ে সাইকেলের সামনের চাকাটা ঢুকে গেল। রাস্তার ওপর ডানদিকে কাত হয়ে পড়ে গেলাম। পায়ে কেডস জুতো আর ফুল প্যান্ট ছিল বলে রক্ষে। চেনের কালিতে প্যান্টের দফারফা, কনুইয়ের কাছে ছড়ে গেছে, ডান হাতের চেটোয় মনে হচ্ছে জ্বলছে -- হ্যাঁ, ছড়ে গেছে। লম্বা ফর্সা ভদ্রলোকটি আমাকে উদ্ধার করলেন। তখন দেখলাম গার্ডবাবু, কাঁধে একটা কালো ব্যাগ-- ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি ফিরছিলেন বোধহয়। তখনই এই বিপত্তি। এক নবিস বালকের সাইকেলের গুঁতোয় তিনি আহত হলেও আমার করুণ মুখ দেখে বোধহয় দয়া হয়েছিল। নিজের পশ্চাদ্দেশের ব্যাথার চেয়েও সন্তানবৎ এই কিশোরের পতন বেদনাকে তিনি বেশি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই নিজে উঠলেন, আমাকে ওঠালেন, সাইকেলটা ওঠালেন, তারপর মৃদু হেসে বললেন, 'নতুন শিখছ বুঝি! যাও, আস্তে আস্তে সাবধানে যাও।' ভাগ্যিস কোথায় থাকি, বাবার নাম-ধাম কি -- এসব জিজ্ঞেস করেননি! আমিও বাড়ি ফিরে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ডেটল আর বোরোলিন লাগিয়ে দিলাম। শীত তখনও তেমন পড়েনি, তবু একটা ফুলহাতা টি-শার্ট সেদিন পরে রইলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, মেসোর সাইকেল আর না। আমার হারকিউলিসই ভালো।

অথ সাইকেল কথা -- পূর্ণ বিকশিত 

    এই ঘটনার তিন-চার বছর পর রেল শহর ছেড়ে এলাম সদাব্যস্ত মহকুমা শহরে। রেল-অঞ্চল বা কলোনি এখানেও আছে, তবে শহর থেকে দূরে -- সাইকেল আর রিক্সা সেখানকার প্রধান বাহন। আশির দশকে তখন সেখানে আজকের মতো চারচাকাদের এত দৌরাত্ম্য ছিল না -- শহর অঞ্চলেও রিক্সা আর সাইকেলে গিজগিজ করত -- বলা ভালো গলাগলি করে চলত। তবে চা-বাগানের জিপগাড়ি, বেশ কিছু স্বল্প দূরত্বের বা দূরপাল্লার বাস, মেডিক্যাল ভ্যান, পুলিশ ভ্যান, ট্রাক, ভেস্পা স্কুটার, মোপেড, কয়েকখান অ্যাম্বাসেডার ছাড়া আর কোনো ধরনের পেট্রোল বা ডিজেল চালিত গাড়ি সেখানে দেখা যেত না। অতএব নির্ভয়ে সাইকেল চালানো যেত। বরং বলা ভালো সেখানে সাইকেল চালানোটা ছিল একটা আর্ট বা বলা যায় অনেকটা অঙ্ক আর সায়েন্সও। কেননা সাইকেল চালকেরা এখানে চলে এঁকেবেঁকে -- কখনও দুটো রিক্সার মাঝখান দিয়ে, কখনও পথচারিদের পাশ কাটিয়ে হঠাৎ হঠাৎ গতি কমিয়ে বা বাড়িয়ে শরীর বেঁকিয়ে (এখন যেমন বাইকওয়ালারা চালায়)। ব্যাপারটা চোখ সওয়া হয়ে গেলে মনে মনে আমারও কনফিডেন্স বাড়ল এবং মামার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে শুরু করলাম প্রায়ই। শিখে গেলাম ভিড় রাস্তায় কীভাবে কখন প্রয়োজন অনুযায়ী ডান হাত বা বাঁ-হাত রিক্সার হুডের বাঁশ বা লোহার হাতল ধরে বিনা পরিশ্রমে এগোনো যায়, কখন এবং ঠিক কোন অ্যাঙ্গেলে দুটো রিক্সার মাঝ বরাবর রাস্তা করে নিতে হয়, পাশাপাশি আট ইঞ্চি দূরত্বে পঁচাত্তর ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দাঁড়ানো দুটো রিক্সার চাকার মাঝ বরাবর ক্রমে পনেরো থেকে পঞ্চাশ ডিগ্রিতে স্ট্যান্ডিং অবস্থায় সাইকেলের চাকা ঘুরিয়ে বেরোনোর জায়গা করে নেওয়া যায়। 

    কিন্তু মামার সাইকেলে হেডলাইট ছিল না। তাই অতটা এক্সপার্ট হয়েও এক সন্ধ্যায় টিউশন সেরে বাড়ি ফেরার পথে একটি প্রায় জনশূন্য কালভার্টের সামনে 'পথবন্ধ' মার্কা পাথরে ধাক্কা খেল এবং আমি খালের জলে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম কোনো রকম আঁচড় ছাড়াই। সাইকেলের বেলটা অবশ্য আর খুঁজে পাইনি, ক্যারিয়ারের একদিকের স্ক্রু খুলে যাওয়ায় সেটাও নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল আর টিউশনির  টাকাটা তখনও পাইনি। অতএব কাঁচুমাচু হয়ে মামাকে বৃত্তান্ত জানাতেই হয়েছিল। ফলে মাঝের ঘরে যখন আমি দিদা, মামীরা ও মামাতো ভাইবোনদের মাঝে আমি যখন একটি চিড়িয়াখানায় তখন পাশের ঘর থেকে মামার বজ্রনির্ঘোষ, 'আর কোনোদিন আমার সাইকেল ধরবি না।' এর একটাই অর্থ বাড়ির আর কোনো সাইকেলেই আমার স্পর্শ পড়বে না। অতএব তেন ত্যক্তেন।...     

অথ সাইকেল কথা -- বৃন্তচ্যূত 

    এবার আমার সাইকেলাকর্ষণের ইতি-কথা। এবারের পর্ব আর মহকুমা নয় একেবারে রাজধানী শহরে। গাড়িঘোড়ার প্রকোপ বেড়েছে কিন্তু লোকে সাইকেল চড়ে এখানে। অফিস-কাছারিতে রীতিমতো সাইকেল-স্ট্যান্ড আছে। বাবার হারকিউলিস এখনও হেরে যায়নি। বরং কালো রঙ আর মবিলে বেশ চকচকে হয়েছে। রিমের ওপরে সাইকেলের পেছন দিকের বনেটটা যদিও লজঝড়ে মার্কা হয়েছে। তবু চলে। নতুন করে ফ্রন্ট বাস্কেট আর লক লাগানো হয়েছে। বাজার-টাজার আনতে বেশ সুবিধে হয় -- বাবারও, আমারও। রাজপথের ধার ঘেঁষে চালিয়ে দিব্বি শহরের এ-মাথা থেকে অ-মাথা যাওয়া যায়। যাইও। 

    আমার প্রথম কর্মস্থলে প্রয়োজন না হলেও দ্বিতীয় কর্মস্থলে একটা সাইকেল 'নেসেসারি' হয়ে উঠলো (ইংরেজিতে বললে বক্তব্যের জোর বাড়ে বলেই শব্দটা ব্যবহার করতে হলো)। অথচ যা বেতন, তাতে সাইকেল কেনাটা পঞ্চবর্ষীয় পরিকল্পনার অধীন। হাত খরচ চালানোর জন্য বাবা মাসোহারা পাঠান। মাস চারেক পর হবু গৃহীনির টিউশনের চারশো টাকা আর আমার বেতনের আটশো টাকা দিয়ে অবশেষে হিরো এলেন। ঝাঁ-চকচকে। মনটাই হয়ে গেলো ফুরফুরে। মনে হতো পংখীরাজের পিঠে চড়ে চলেছি .....

    তৃতীয় তথা বর্তমান কর্মস্থলে বহুদিন সঙ্গী ছিল ওই হিরো। তাকে বাসের মাথায় চড়িয়ে নিয়ে এসেছিলাম দ্বিতীয় কর্মস্থল থেকে। বাসস্ট্যান্ড থেকে ওই সাইকেলে চড়েই মালপত্তর সহ বাড়ি ফিরি। তো কর্মস্থলে বেশ কয়েকজনের গাড়ি ছিল, আর ছিল বাইক বা স্কুটার। কয়েকজন অবশ্য পয়দল আসতেন। তার মধ্যে আমার এক সহকর্মীও ছিলেন। তিনি সাইকেল চালান, কথাটা বোধহয় সহকর্মীদের জানাতে চাইতেন না। তাই প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে রেললাইনের পাশে একটি সাইকেল সারাইয়ের দোকানে নিজের সাইকেলটি জমা দিয়ে আসতেন। ফেরার সময় ওইটুকু পথ হেঁটে গিয়ে তারপর সাইকেলে চেপে বাড়ি। আমি হিরোকে সঙ্গে করেই দিনাতিপাত করছিলাম। অবশেষে পাঁচ বছর পর যখন বেতন বাড়লো আর সহকর্মীরাও একে একে বাইক বা স্কুটার ভক্ত হয়ে উঠলেন তখন একদিন হিরোর সিটে হাত রেখে বললাম, 'বন্ধু, তোমায় বোধহয় এবার ছাড়তে হবে।'

    মা-বাবা বললেন, 'সাইকেলটা তাহলে কী করবি, কাউকে কম দামে বিক্রি করে দে।' আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম, 'মাথা খারাপ! অ্যাক্টিভা তো সবসময় চালানো যাবে না। প্রচুর তেলের দাম। মাসে একবার ফুল ট্যাঙ্কে যতদিন যায়, শুধু অফিস আসাযাওয়া। অন্যসময় সাইকেলটাই।' যেমন কথা তেমনি কাজ। প্রথম কয়েকমাস হিরো বাবা ও আমার সঙ্গে বাজারে যায়, কাছাকাছি এদিক-সেদিক যায়। তারপর থেকে সে শুধু বাবার সঙ্গেই যায়। বাবা একদিন আমার শিশুকন্যা সহ জলের মধ্যে পড়ে গেলেন। তারপর থেকে হিরোকে বাবাও খুব একটা সঙ্গী করতে চাইলেন না। তারপর একদিন ...... হিরো অভিমান করে চলে গেলো কলমিস্ত্রি দেবেনের সঙ্গে। 

    এতগুলো বছর পর আজ হঠাৎ করে হারকিউলিস, র‍্যালে আর হিরোদের কথা মনে পড়ছে। বোধহয় ওদেরকেই ফিরিয়ে আনতে হবে। জগতের নিয়ম তো চক্রবৎ ঘুরে চলা -- শেষ বিন্দু থেকে শুরুর বিন্দুর দিকে। তাই আকর্ষণটা এখনও একই রকম আছে, ত্যক্তেন আর করতে পারলাম কই ....শেষমেষ আরেকটি সাইকেল এলো -- তবে সে চলে কিন্তু চলে না। চাকা আছে, ঘোরে কিন্তু সাইকেল দৌড়য় না। সেটা ঘাম ঝরানোর জন্য, শরীর চর্চার জন্য। বেশ কিছুদিন চালানোর পর তারও কদর কমে গেল। জীবনে এলো জিম। আর সেই ব্যায়ামের সাইকেল বরাবরের জন্য অচল হয়ে পড়ে রইল...... 

********