Friday 4 June 2021

গোট-সিনড্রোম বা টাইমপাসের কড়চা

গোট-সিনড্রোম বা টাইমপাসের কড়চা

জ্যো তি র্ম য়  সে ন গু প্ত

 

বি-ব্লকের সন্তোষদা একবার বলতে শুরু করলে আর কাউকে কোন চান্স দেন না, অনর্গল বকে যান। আর যে বিষয় বা যার সম্পর্কে বলা শুরু করবেন তার আখপেষা ছিবড়ে না বার করে থামবেন না, পরিবেশ অনুকূল হলে তো কথাই নেই। আর কেউ যদি প্রতিবাদ করে কোনো কথা বলেছি, ব্যাস পা-দুটো ছড়িয়ে হাতদুটোকে বুকের কাছে ভাঁজ করে থুতনিটাকে প্রায় সেখানে গুঁজে একেবারে থম মেরে বসে থাকবেন – নো নড়ন নট চড়ন। একেবারে ফ্রিজ শট। তিড়িংবিড়িং লাফানো ছাগল হঠাৎ যেমন হাত-পা শক্ত হয়ে পড়ে থাকে ঠিক সেরকম। গোঁসা ভাঙাতে কয়েকটা বড়ো ফিল্টার, দু-তিন কাপ গরম চা তৎসঙ্গে গরম শিঙাড়া খরচা হয়। তারপর তাঁর হাবেভাবে সাড় আসে। তবে আমরা পালা করে এটুকু খরচ সামলে নিই, কারণ অবসর বিনোদনের এত জমাটি সোর্স এই আবাসনে আর কোথায়! বুঝে গেছি, এটা তাঁর মজ্জাগত।

আড়ালে আমরা তাঁকে ডাকি অসন্তোষবাবু বলে, তিনি সেটা জানেন কি না জানি না। আর জানলেও বা কি, আবাসনের পার্কে কয়েকটা রবিবাসরীয় সান্ধ্য আড্ডায় তিনি আসবেন না। আবার একদিন ঠিক ফোন করবেন – ‘কিহে তালুকদার, হবে নাকি আজ?’ আপনি মিলিয়ে নেবেন, একটা না একটা মশলাদার খবর সন্তোষদার কাছে জমা পড়ে গেছে। গল্পের যেন অফুরন্ত ভাণ্ডার তাঁর কাছে, পারেনও হাঁড়ির খবর জোগাড় করতে। নানা রকম রঙচঙে খবরে এবং সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় তাঁর বেজায় শখ। আমরা যখন তাঁর এমন কোন মশলাদার খবরে কুপোকাত তখন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেই ফেলেন ‘আমারও একটা সিক্সথ সেন্স আছে হে। গন্ধ ঠিক নাকে এসে লাগে’।

 বেশিদিন হয়নি সন্তোষ হালদার এখানে এসে উঠেছেন। কাজ করতেন রেলের হেড অফিসে, পি.ডব্লু.ডি-তে এস.ও মানে সেকশন অফিসার হয়ে রিটায়ার করেছেন। রেল কোয়ার্টার ছেড়ে এখন এই আবাসনের স্থায়ী বাসিন্দা। ঘরের আসবাবপত্র দেখে মনে হয় বেশ কামিয়েছেন! গল্পে-গল্পে আমাদের শুনিয়েছিলেন, তাঁর বাবা নাকি সেই কবে ভাগলপুরের রতনলাল সুগার মিলে চাকরি পেয়েছিলেন, না গিয়ে এখানে চলে এসেছেন রেলের ওভারসিয়ার হয়েসেও আরেক গল্প। ওই যে পুরোনো সিনেমাটা, ‘এক আধুরি কহানি’ না কি যেন। আমরা ভেবেছিলাম ইমরান হাসমির ‘হামারি আধুরি কহানি’। বলি বলি করেও সন্তোষদা অসন্তুষ্ট হবেন ভেবে আর এগোতে সাহস করিনি। উনি জোর দিয়েই বলেছিলেন, সিনেমাটা নাকি তাঁর বাবার এক মাসতুতো দাদার গল্প নিয়েই তৈরি হয়েছিল। সিনেমার গল্প লিখিয়ে সুবোধ ঘোষ বেমালুম জ্যাঠামশাইয়ের গল্প মেরে দিয়েছেন। কোথায় ‘গোত্রান্তর’ আর কোথায় জ্যাঠামশাইয়ের সেই গায়ের লোম খাড়া করা হরতালের গল্প। জ্যাঠামশাই বেঁচে থাকলে ঠিক তাঁর মুখেই গল্পটা তিনি তাঁর এই চার ইয়ারকে শুনিয়ে দিতেন।

আবার একদিন ঋতুপর্ণকে নিয়ে পড়লেন। আমরা যতই বোঝাই, ‘আরে দাদা, ও হেনরির গিফট অফ দ্য ম্যাজাই থেকে গল্পটা নেওয়া হয়েছে, ঋতুপর্ণ বলেই দিয়েছেন।’ তবু টলানো যায় না তাঁকে। আমরাও শেষমেশ মেনেই নিলাম যে মনোজ বসুর ‘প্রতিহিংসা’ গল্পটাই আছে ‘নেমসেক’-এ। নাহলে হাল্কা শীতের সন্ধ্যায় পার্কের সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরটা বেশ গরম হয়েই উঠছিল। 

আজকেও, রিয়া চক্রবর্তী, সুশান্ত সিং, ড্রাগস-বলিউড-টলিউডের সনসনি তেজ গল্পগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পর আমরা যখন এন.আর.সি, অখিল গগৈ বা আসুর নতুন রাজনৈতিক দল হয়ে হাথরসে ঢুকব-ঢুকব করছি, ঠিক তখনই ছোটো মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে একতলার বাসিন্দা নিশীথদা মাথা নিচু করে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। গোনাগুনতি পাঁচ থেকে সাত সেকেন্ড, হয়তো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেও পারেননি, তখনই সন্তোষদার মুখ খুলে গেল – ‘দেখলে, তালুকদার দেখলে, কাণ্ডটা দেখলে। আমরা যে আছি এখানে, পাত্তাই দিল না! ভদ্রতা বলতে কিছুই নেই!! দেমাকে দেখছি মাটিতে পা পড়ে না।’

আমরা সবাই যে যার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে নিলাম – ‘আরে উনি বরাবরই একটু চুপচাপ গোছের। তবে নির্ভেজাল। লেখাটেখা নিয়ে থাকেন, মেয়েকে বোধয় টিউশন থেকে নিয়ে ফিরলেননাহার কথায় যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন সন্তোষদা, ‘আরে রাখো তোমার লেখাটেখা। কিছুদিন ধরেই লক্ষ করছি এই ওয়ান-এ-কে, দু-কলম লিখলই বা, পা একেবারে মাটিতেই পড়ে না? তুমি তার লেখার খোঁজ রেখেছ? ক’টা বই লিখেছে বা ক’টা পাবলিশার ওর পেছনে ঘুরঘুর করে, হাতে গুনে বলতে পারবে?’

এরপরই সন্তোষদা ঠোঁট উলটে বুড়ো আঙুলটা আমাদের সামনে একবার ঘুরিয়ে নিলেন, যার মানে হচ্ছে কাঁচকলা। তবে এই কাঁচকলাটাও বেশ অর্থবহ – এক, হতে পারে নাহা কিছুই জানেন না এ-বিষয়ে; দুই, এও হতে পারে যে নিশীথদার বিশেষ একটা এলেম নেই লেখালেখির লাইনেকিন্তু সন্তোষদা বেশ উত্তেজিত ভাবেই ধারাবিবরণী শুরু করে দিয়েছেন, ‘এ না কি লেখে – গপ্প, কবতে, নাটিকা সবি নাকি লেখে, কাগজে আবার ছাপায়ও!! কে পড়ে বাবা জানি না। লেখক হতে গেলে অরিজিনাল কলমের জোর দরকার। এরকম লেখক পাড়ার সেক্রেটারিকে ধরে-কয়ে দুগগো পুজোর স্যুভেনিরে কখনও একটা তিনপাতার লেখা বা বড়ো জোর একখানা দশ-বারো লাইনের কবিতা ছাপায় – দৌড় তো ওই পোজ্জন্তইআরে বাবা, কত্ত ওরকম রাইটার দেখলাম। সুনীল-সমরেশের কথা ভেবে তো লাভই নেই, আগে একটা প্রফুল্ল রায় কি নিমাই ভটচাজ হয়ে দেকাও দিকিনি! নিদেনপক্ষে একখানা সৌরভ চলিহা কি শীলভদ্র হতে পারলেও কথা ছিল।’

আমি বাধা দিলাম, ‘আহা, ছাড়ুন না। অন্যের ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করার দরকার কি? বরং হাথরসের ওই মণীষা মেয়েটার কথা কি বলছিলেন, সেটা শোনান।’

– ‘আরে বলছ কি তালুকদার, ওই ম্যাটারটাই তো ম্যাটার করছে। ইন্টারফেয়ার করা হবে কেন, জানতে চাওয়াটা দোষ? এই যে রিয়া চক্রবর্তী – আফটার অল বাঙালি তো, কিছু বলা যাবে না? বা এই যে রেপড মেয়েটা -- হয়তো মরেই যাবে, ইন্টারফেয়ার করা বললে তো এদের নিয়ে কথা বলাই চলে না, মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে হয়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে এই ম্যাটারগুলোতে যদি মন খুলে কথা না-ই বলতে পারি তো কীসের বাক স্বাধীনতা? আমি তো লম্বা করে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছি। প্রচুর লাইক মেরেছে সবাই।’

নাহা একটু খুঁচিয়ে দিল, ‘লাইক পেয়েই আপনি কাইত হয়ে গেলেন? ওরকম তো আমরা হাজারটা পাই। আপনার এই স্যোসাল কাপে ঝড় তুলে কী লাভটা হয়েছে বলুন তো? কিছু ঝাপটা ফেসবুকের বাইরে এসেছে নাকি ওখানেই নাইটফল হয়ে গেছে?’

সন্তোষদা মনে হলো ভাবছেন, বাউন্সারটা ডাক করবেন না খেলবেন চোখ সরু করে গলা নামিয়ে নাহাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ক্যাকোফোনি চেনো? কাকের কর্কশ গান?’ চক্রবর্তী শুধরে দিল, ‘ওটা কাকের গান নয়, বেসুরো ব্যাপার-স্যাপারকে বলে ক্যাকোফনি

– ‘একদম তাই। লাভালাভ দেখে স্যোসাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়াটা চরম সুবিধেবাদী ব্যাপার। এই যে তুমি পোস্ট দেওয়া নিয়ে বললে, সেটা ঠিক ওই কাকের গানের মতোই।’    – ‘বেশ, তাহলে হাথরসের সঙ্গে কাশ্মীরের মেয়েটির কথা আনুন, অর্ণমাই বরাকে আনুন, দুটো অরুণাচলি বাচ্চা কাজের মেয়েকে যে রেপ করল মালিকের ছেলে সে কথাটা বলুন, আরটিকাল ২১—হিউম্যান রাইট নিয়ে কথা বলুন!’

–‘তোমাদের এই এক রোগ, সবকিছু রেলিজিওন অ্যান্ড রিজিওনাল পলিটিকসে টার্ন করিয়ে দিতে চাও। আমি তোমাদের মতো কালারড পলিটিকসে বিশ্বাস করি না। ইন ফ্যাক্ট, কোন পলিটিকাল আইডেন্টিটি আমার নেই, আর তোমাদের এই ক্যাকফনিতে মাথা গলিয়ে সাধের রাজনৈতিক ভ্রমণ পিপাসু হবার কোন ইচ্ছেও নেইযখন যে বিষয়ে বলা উচিত মনে করি, সেটাই বলি। কোন পোস্ট ট্রুথে মাথা গলাই না।’

হো হো করে হেসে ফেলল চক্রবর্তী, ‘প্লিজ, সন্তোষদা চেপে যান। আর এগোলে নাহা এমন বল থ্রো করবে যে আপনি সাডেনলি আবার ফ্রিজ শট হয়ে যাবেন। আপনার তো আবার  মায়োটনিয়ার অভ্যেস আছে।’ আমরা সমস্বরে হেসে উঠলাম। কিন্তু সন্তোষদা মনে হল ক্ষেপে গেলেন,–‘মানে?!!’                                                                        – ‘মানে, মায়োটনিয়া কনজেনিটা, যাকে সোজা করলে দাঁড়ায় গোট সিনড্রোম। পোষা কুকুর-ছাগলকে দেখেছেন চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়তে?’ আমি খুলে বললাম।

সন্তোষদা জুৎসই জবাব দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু এবার রসে ভঙ্গ দিল নিশীথদার মেয়েটি। সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দার করে নেমে একেবারে সন্তোষদার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো, ‘জেঠু-জেঠু, একটা হেল্প করবে প্লিইজ...?’সন্তোষদা একটু থতমত, প্রথমটায় চুপ করে মুখ ঝুলিয়ে রাখলেন। আমরা বেশ উৎসাহিত, কীই বা হেল্প! মেয়েটি সন্তোষদার উত্তরের অপেক্ষা না করেই গড়গড় করে এক নাগাড়ে বলে গেল, ‘আমি না, অ্যানুয়াল ফাংশানে মিনি সাজব, তুমি আমাদের কাবুলিওলা হবে?’

‘অ্যাঁ’!!! – সন্তোষদা তিড়িং করে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। আমরা কেউ হাসি চাপতে পারলাম না। সন্তোষদা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি তোমার কাবুলি সাজব, এটা কার আইডিয়া শুনি?’

একদিকে আমরা হাসছি আর ক্ষেপে গেছেন সন্তোষদা – এই অবস্থায় মেয়েটি ঘাবড়ে গিয়ে ছোট্ট করে বলল, ‘বাবা’।   সন্তোষদা আবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা রবিঠাকুরের রোলটা কি তোমার বাবা করবে?’ বেচারি ঘাবড়ে গেল। এক দৌড়ে সে যেমন এসেছিল, তেমনই পালালো। চক্রবর্তী চেঁচিয়ে বলল, ‘মামনি, বাবাকে বলো আমরা ডাকছি, আর তোমার জেঠু ঠিক কাবুলি সাজবে।’

এই যাহ, সন্তোষদা আপনি আবাসনের কাবুলি হয়ে গেলেন!! – নাহা একটু খুঁচিয়ে দিল, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট নিয়ে ওর রাগটা তখনও পড়েনি। সন্তোষদা চুপ। আমরা ভাবছি একটা ফায়ার বল এলো বলে। এবার আবাসনে থার্টিফার্স্টের ফাংশনে সন্তোষদা রিসাইটেশন আর মূকাভিনয় করবেন, ঠিক হয়ে আছে। হঠাৎ শত্রুপক্ষের উটকো হামলা -- রিঅ্যাকশন কী হয়!

কিন্তু সন্তোষদা আমাদের অবাক করে বেশ শান্ত ভাবেই বললেন, ‘একটা জিনিস কি জানো, অভিনয় ব্যাপারটা আমাদের রক্তে মিশে আছে বড়ো বড়ো অ্যাক্টরের সঙ্গে তো আমাদের একরকম ফ্যামিলি রিলেশনই ছিল। তবে ওই মূকাভিনয়টা তাহলে আর করছি না, কি বলো? কাবুলিওয়ালাটা কিন্তু খুব চ্যালেঞ্জিং। মিতেজ্যাঠার অভিনয় তো এই দু-হাত দূর থেকে দেখা।’ আমরা তাঁর তর্জনী নির্দেশিত দুহাত দূরে তাকিয়ে অন্ধকারে বাউন্ডারির গায়ে দাঁড়ানো ইউক্যালিপটাসগুলোকেই দেখতে পেলাম।

নাহা আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। চক্রবর্তী হাতের ইশারায় তাকে চুপ করতে বলে সন্তোষদাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মিতেজ্যাঠা কে? এঁর কথা তো আগে শুনিনি!’ একগাল হেসে সন্তোষদা চক্রবর্তীর দিকে ঘুরলেন, ‘তোমরা আর কতটুকু জানবে। একটা সিগারেট হবে নাকি? তাহলে শোনাতে পারি  মিতেজ্যাঠার গল্প।’

বুঝলাম, আবার এক গল্পে পেয়েছে সন্তোষদাকে, আপাতত নিশীথদা বাদ। আমাদের সোসাইটির ক্যাসিয়ার অসীমবাবু পকেট থেকে উইলস ফিল্টারের প্যাকেটটা বার করে এগিয়ে দিলেন, চক্রবর্তী লাইটার। ‘স্যানিটাইজ করা আছে তো?’ সন্তোষদার প্রশ্ন, আবার নিজেই উত্তর বার করে নিলেন, ‘অবশ্য আগুনে কোন দোষ নেই’। তারপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে শুরু করলেন, ‘সেসব কি দিন গেছে! মা গান-বাজনা ভালোবাসতেন। ওই জ্যাঠামশাই ধরে ধরে আনতেন সব আর্টিস্টদের। একসঙ্গে ওঠাবসা ছিল তো। একবার কলকাতা থেকে নিয়ে এলেন মিতেজ্যাঠাকে।’

       চক্রবর্তীর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘মিতে জ্যাঠা কোলকাতার??!!’ – ‘আরে তোমাদের তো বলাই হয়নি, অবশ্য কতই বা আর বলব, লকডাউন বলেই না একটু আধটু বসে কথা বলতে পারছি। তা মিতেজ্যাঠা হল অজিতেশ ব্যানার্জী। নাম শুনেছ তো? জ্যাঠামশাইয়ের একেবারে ল্যাঙ্গোটিয়া দোস্ত, নেমসেক, বুঝলে না!! তো সেবার রেলের মাঠে বিশাল আয়োজনওঁর অভিনয় দেখার জন্য একেবারে লোক ভেঙে পড়েছিল। আমাকে তো বাড়িতে রিহার্সাল করার সময় ডেকে নিতেন। বলতেন, সতু তুমি আমার এই পার্টটা একটু করে দাও দেখি।.... আমি আবার ভুলটুল কিছু হলে ঠিক ধরতে পারতাম। তো, যে ক’দিন বাড়িতে ছিলেন আমাকে দিয়েই ভুলগুলো শুধরে নিতেন।’

‘ভুলগুলো শুধরে নিতেন ওঁকে দিয়ে????!!!’ -- আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। অসীমবাবু জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, ‘আপনি নাটক করতেন!’- সন্তোষদা থেমে গিয়ে,  যেন ওটা বাঁ-হাতের খেল, এমন ভাবে বললেন, ‘ওই একটু আধটু আর কি। রেলের কম্পিটিশনগুলোতে আমাকে ছাড়া তো চলতই না। ডিরেকটর কাম দলের ম্যানেজার....।’

আমি অনেকক্ষণ ধরেই সুযোগ খুঁজছিলাম। সন্তোষদা একটু থামতেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘তাহলে নিশীথদাকে নিয়ে আপনার আর কোনো অবলিগেশন নেই, ওঁর মেয়ের সঙ্গে আপনি কাবুলিওয়ালার ভূমিকায় অভিনয় করছেন এবার?’ চক্রবর্তী ফোড়ন কাটল, ‘ইসস আগে জানলে আপনাকে একক অভিনয় করতে বলতাম। এক কাজ করুন, নিশীথদার সঙ্গে জয়েন্টলি কবিতার অন্ত্যাকশরী করুন। রিসাইটেশন পর্বটা জমবে ভালো।’

চোখ কটমট করে সন্তোষদা চক্রবর্তীর দিকে ঘুরে বসলেন, রেগে গেলে উনি সবাইকে ‘আপনি’ সম্বোধন করেন, ‘কখখনো নাওসব এলেবেলে প্রোগ্রামে মুড নষ্ট করে লাভ আছে কিছু? ভালো সুরেলা গান শুনলাম কি দুটো বাচ্চার নাচ দেখলাম কি গুণী মানুষের দুটো ভালো ভালো কথা শুনলাম – এপর্যন্ত ঠিক আছে। এমনকি ধরুন ওই যে আপনারা লিটল ম্যাগাজিনের প্রদর্শনী করবেন বলে ঠিক করেছেন, সেটাও মন্দ নয়। কিন্তু ফাংশানে যার তার সঙ্গে আমায় বসাবেন না। সন্তোষ হালদারের একটা ইয়ে আছে।’

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাবুলিওয়ালার রোলটা?’ – ‘সেটা সময় এলে দেখা যাবে’ – সন্তোষদা আবার ফ্রিজ, স্পিকটি নট।  মরিয়া হয়েই বললাম, ‘নিশীথদাও কিন্তু নাম করেছেন।’ আবার সন্তোষদার বম্বিং – ‘হ্যাঁ করেছেন। ওই যে বললাম, একে তাকে ধরে রাইটার হয়েছেন।’

নাহা, চক্রবর্তী – দুজনেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘সন্তোষদা, আপনি কিছুই জানেন না। নিশীথদার লেখক হিসেবে নাম-ডাক আছে। ওই যে, আপনি আগে কাদের কথাটথা শুনে বলতেন, এখানে একজনই কবি আছেন – সেগুলো যারা বলে, তারা হয়তো ওঁর লেখা না পড়েই বলে। এই তো এবছরই একটা কবিতার বই বেরোল কোলকাতার পাবলিকেশন থেকে। আমাদের কাগজে এবার ‘দেশের কবিতায় বিদেশের গন্ধ’ শিরোনামে একটা দারুণ প্রবন্ধ লিখেছেন। ’

সন্তোষদা দমবার পাত্র নন, তাঁর যুক্তি – পকেটের পয়সা খরচ করে অমন বই অনেকেই ছাপায়,‘পড়ে কজন? ও আপনারাই পড়েন আপনারাই বোঝেন, আপনারাই পিঠ চাপড়ান। জোর করলে আমাকেও হয়তো কখনও বলতে হবে আপনাদের এই নিশীথ ভটের লেখা দুর্দান্ত, .... জাস্ট ছুঁয়েও দেখব না ওসব ছাইভস্ম।’

‘আপনি পড়েছেন ওঁর লেখা’ – চক্রবর্তীর প্রশ্নের জবাবে সন্তোষদা অম্লান বদনে মাথা হেলান

 – ‘কোনটা?’ – এবার নাহা

– ‘গত মাসে ‘ছুটির জানালা’তে বেরোল যে, আমাকে তালুকদারই তো পড়তে দিয়েছিলে, নক্ষত্র পতন না কি যেন!’

হ্যাঁ, আমিই সন্তোষদাকে গতমাসে দিয়েছিলাম কাগজটা, সঙ্গে নিশীথদার সদ্য বেরোন কবিতা বইয়ের একটা কপিও – নিশীথদা রেখে গিয়েছিলেন ‘শতভিষা ঝরে পড়ছে’র কয়েকটা কপি। পড়ে আমি বেশ চমকে গিয়েছিলামসন্তোষদা সেটার কথাই বলছেন, ‘আরে ওই যে আত্মপরিচয় খুঁজছে একটি মেয়ে, পরে রাস্তায় বাপকে দেখল মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, ভাইকে দেখল শ্রমিকের সঙ্গে হাঁটছে, মাকে দেখল লালকেল্লার চূড়োয়.... ব্যাস হয়ে গেল। এগুলোকে কবিতা বলেন আপনারা!! কি বলো ভায়া?’

আমি একটু অবাকই হলাম, নাহা আর চক্রবর্তীরও একই অবস্থা, ‘নক্ষত্র পতন!! এ-নামে কোন কবিতা নিশীথদা লিখেছেন? তালুকদার ???’ – প্রশ্নটা আমার দিকে উড়ে এলো।

অতএব আমাকে বলতেই হলো, ‘না, সন্তোষদা, আপনার বোধহয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আপনাকে তো দিলাম পড়তে, দুদিন পর ফেরতও দিলেন, বললেন ভালোই লেগেছে। বইটাও বললেন, প্রচ্ছদ খুব সুন্দর হয়েছে – কবিতাগুলোও ভালো! কিন্তু এ নামে তো নিশীথদার কোন কবিতা নেই, ছুটির জানালাতেও নয়। আর আমি তো আপনাকে দিলাম ‘সকালবেলা’র রবিবাসরীয়! আপনি ‘ছুটির জানালা’ পেলেন কোথায়?’

– ‘যেটাই হোক। কবিতা হওয়া নিয়ে তো কথা? কবিতাই হয়নি। কোথায় সেই ‘ছিপখান তিন দাঁড়’ বা ‘পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি’র মতো ছন্দ, ভাব -- আর কোথায় আপনাদের এই নিশীথ ভটের কবতা! শুধু বাঃ দারুণ বলে পিঠ চাপড়ে দিলেই হলো? কোয়ার্টার ছেড়ে আসার সময় কত্ত বই ম্যাগাজিন সব বিক্রি করে দিয়ে এসেছি। দেখলে বুঝতেন। ভালো ভালো লেখা পড়ে আমাদের টেস্ট তৈরি হয়েছে, এমনি এমনি নয়ওরকম দেশের কবিতায় বিদেশ আমিও দুচারখানা লিখে দিতে পারি। নেহাত ভদ্রতার খাতিরে বলতে হয় তাই হয়তো সেদিন বলে ফেলেছি....

‘লে বাবা!’, চক্রবর্তী এবার একটু রেগেই গেল, ‘সন্তোষদা, আপনি যাই বলুন। নিশীথদাকে কিন্তু এভাবে ফেলে দিতে পারবেন না। শুধু লেগ পুলিং করে গেলে কিন্তু কোন লাভ হবে না।’

–‘তা হোক না চক্কোত্তি, আমার তাতে কিছু এসে যায় না। যা সত্যি তা সবসময়েই সত্যি, মিথ্যেকারের সত্যি নয়, ট্রুথ মিন্স ট্রুথ। আগে দশটা লোকে বলুক, লোকে বই কেনার জন্য ভিড় জমাক দোকানে, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য হোক, তারপর নাহয় বুঝে নেব। কথায় বলে ‘আপনারে বড়ো বলে বড়ো সেই নয়’, দশজনে যতক্ষণ না বলছে ততক্ষণ কেউ আর কেউকেটা নয়। আপনাদের নিশীথবাবুও নয়, সে আপনারা যতই চেঁচান’

নাহা রেগে কাঁই, সন্তোষদাকে চার্জ করল সোজাসুজি – ‘ট্রুথ! মাই ফুট। ওটা আপনারই বানানো ফলস ট্রুথের স্যাম্পল। আপনি জানেন, নিশীথদার কবিতা নিয়ে যাদবপুরের কম্পারেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজের ছেলেমেয়েরা ওয়ার্কশপ করেছে গত জুন মাসে? জানেন ‘অবভাসিত’র কবিতাগুলো উনি দেখে না দিলে সম্পাদক ছাপান না?’

--‘না , জানি না।’

– ‘তাহলে শুধু শুধু অপবাদ দিচ্ছেন কেন? আপনি দেখান যে এখানকার সাহিত্য জগতের অনেক খবরই রাখেন, আসলে পড়েননি প্রায় কিছুই। কয়েকজন নামকরা ছাড়া এদিককার লেখা পড়া তো দূর ছুঁয়ে দেখার সুযোগ আপনার হয়েছে কি না সন্দেহ। নামকরাদেরও বা ক’টা গল্প-কবিতা পড়েছেন, সন্দেহ আছে। বাংলা কবিতার এক নম্বর লিটল ম্যাগাজিন ‘অবভাসিত’র নামই শোনেননি। অথচ বারফট্টাইটা ঠিক আছে। এরপর আবার বলে না বসেন মার্ক্স, ফ্রয়েড, কাফকা, বাখতিন মায় স্যসুর পর্যন্ত সব আপনার রক্তে আছে, আর তাই কয়েকজন ছাড়া বাকিরা এখানে লিখতেই জানে না।’

নাহা শেষ করার আগেই সন্তোষদা উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, হাত নেড়ে নাহাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ কথাটা শোনার পর তাঁর চোখমুখের ভাব বদলে গেল, একরোখা ভাবে তিনি গলা চড়ালেন, ‘যে লিখতে জানে না তাকে লেখক সাজানোর জন্য আমার কোন দায় পড়েনি, ভুলভাল কিছু বলিনি আমি। আর কথায় কথায় অত স্যসুর-শাশুড়ি-বাখতিন কপচাবেন না তো। ওই যে বলে না সফরী ফরফরায়তে, আপনার হয়েছে সেই দশা।’

নাহাও কম যায় না। সেও গলা উঁচিয়ে সন্তোষদাকে জবাব দিল, ‘নিশীথদা সামনে নেই, ওঁর লেখাও আপনার পড়া নেই, কারও একটা শোনা কথায় শান দিয়ে আপনিই সফরীর মতো ফরফর করছেন। ওঁর সামনে দাঁড়ানোর সাহস হবে না আপনার মতো ট্রুথ বিল্ডারেরসত্যিকার পাঠকের কাছে ওঁর লেখার কদর আছে, বুঝলেন?’

অসীমবাবু অনেকক্ষণ ধরে কথাবার্তা শুনছিলেন, খানিকটা বিরক্ত ভাবেই। এবার তিনিও উঠে দাঁড়ালেন, ‘শুধু শুধু নিজেদের মধ্যে একটা অদরকারি ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা করতাছেন। এই লকডাউনের সময় আপনারা কাজিয়া শুরু করছেন কে কি নয় তাই নিয়া। কই থারটিফাস্টের প্রোগ্রাম নিয়া আলোচনা করবেন, না এখন নিশীথবাবুকে নিয়া পড়সেন। এদিকে জিনিসপত্রের দাম যে হুহু করে বাড়তাছে তা দ্যাখছেন? আজকেও তেল কিনলাম প্যাকেটে আগের রেটের থিক্যা একুশ টাকা বেশি, হোলসেলে দাম বাড়াইয়া দিছে। ডেটল মারকেটে সাপ্লাই নাইজামাইয়ের প্রাইভেট ফারমের চাকরি খাইয়া নিছে মালিকে, মেয়ের মুখ চাইয়া ওরে এইখানে আমার দোকানে বসাইছিরাস্তার ওইপাশে প্রায় সব বাড়িতে করোনা ধরা পড়ছে। মানুষ বাঁচে কিনা ঠিক নাই, গরিবগুলানের  মুখে দুমুঠো তুইল্যা দেওয়ার কেউ নাই, যে পারছে সে সবজি বা মাছ ব্যাচতে বইয়া গ্যাছে। অতগুলা লেবার সেইদিন ঘুমের মইধ্যে মইরা গেল চাক্কার তলায়, আর আপনারা কাজিয়া করছেন নিশীথবাবুর লেখালেখি নিয়া ধুত্তারিকা!’  কথাগুলো বলে তিনি রাগটা চেয়ারের ওপর ঝেড়ে আড্ডা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন

আমরা সবাই চুপ, ঠিকই তো – এই মুহূর্তে আমাদের কাছে অদরকারি ব্যাপারটাই বড্ড দরকারি হয়ে পড়েছেকরার কিছু না থাকলেও চেল্লাবো। কিন্তু সন্তোষদা গরগর করেই চলেছেন, ‘কাজিয়া আমি করি না, লকডাউন তো সরকারি ম্যাটার, আমার একার ব্যাপার তো না, করোনা-টরোনা এগুলো গভমেন্টের দেখাই তো উচিত,  আর আমার অত সময়ও নেই অহেতুক বাজে কথায় নাক গলাবার

চক্রবর্তী তাঁকে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু চুপ করে গেল। অন্ধকারে আমাদের পেছন থেকে তখনই একটা গম্ভীর স্বর ভেসে এলো, ‘অথচ ঠিক সেই কাজটা করেই সময় কাটাচ্ছেন এতক্ষণ ধরে।.....’

আমরা চকিতে খেয়াল করলাম, আধো অন্ধকারে একটা ঋজু মানুষের ছায়া—নিশীথদা!! মাস্কটাকে থুতনি থেকে ওপরে টেনে নাক পর্যন্ত ঢেকে নিলাম চট করেসন্তোষদাও দেখছি তড়িঘড়ি স্ট্যাচু হয়ে গেছেন।

--------

 

 

No comments:

Post a Comment

Note: only a member of this blog may post a comment.