Thursday 3 June 2021

অথ সাইকেল কথা

 অথ সাইকেল কথা -- কুঁড়ি পর্ব     

     ছোট্ট লাল ট্রাইসাইকেলের ওপর আমার চিরদিনের আকর্ষণ। সেই বালকবেলাতেই সামনের বাড়ির তিন ভাইবোনকে পালা করে ট্রাইসাইকেল চড়তে দেখে আমারও ইচ্ছে হতো। কিন্তু ওপরওয়ালা যে তখন থেকেই আমাকে ঔপনিষদিক করে রাখবেন, কে জানত! 'তেন ত্যক্তেন' -- পাচ্ছি না, অতয়েব ইচ্ছে এবং আশা ত্যাগই একমাত্র পন্থা। কতদিন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেছি -- ওদের বাড়ির বড়ো দিদিটি একটু হাল ছাড়তেই ছোটো বোনটিকে ঠেলে নিয়ে যাবার দায়িত্ব পেয়ে বর্তে গেছি। মমেতি ন মমেতি চ-- হোক না সামনের বাড়ির সাইকেল, তবু ঠেলে ঠেলে খেললাম তো! 

    রেলশহরে তখন কেরোসিন শব্দটাই পরিচিত -- একটা বড়ো ট্রাইসাইকেলের ওপর তেলের ড্রাম শুইয়ে বাবুল, সখারাম, সুবামনিরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরত। যখন যে পাড়ায় তখন সে পাড়ার 'আমরা' পিছু পিছু ঘুরতাম, কী এক আকর্ষণে! আরেকটা ভদ্রগোছের ট্রাইসাইকেল ছিল -- একদিন জানলাম, তাকে বলে রিক্সা, বন্ধুদের কেউ কেউ বলত 'রিসকা'। দুটোর মাঝে কোনটা বেশি কেতাদুরস্ত, তা বুঝতে পারতাম না। তবে প্রতিভা দিদিমনি একদিন আচ্ছা করে কান মলে বইয়ের ছবিতে আমার সরু সরু মোলায়েম তর্জনি চেপে ধরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ওটা রিসকা নয় রিক্সা। তা কোনদিনই রেলশহরের বাবু আর অসুস্থ রোগীদের জন্য বরাদ্দ রিক্সায় চাপিনি, বরং বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাইসাইকেলে চাপার আকাঙ্ক্ষা চাগিয়ে উঠছিল। 

    বাবার একখানা হারকিউলিস সাইকেল ছিল, শুধু বাবার কেন -- হাতে গোনা দু-একজন বাদে রেলপাড়ায় সবারই ছিল -- অফিস যাবার জন্য। কালো রঙটা বেশি থাকলেও কিছুদিন পর র‍্যালের সবুজও এসে গেল। রাতের বেলা পেছন থেকে রেডিয়ামের লাল আলোটা স্বপ্নের মায়াজাল বুনত। স্ট্যাটাস অনুযায়ী সাইকেলের সাজসজ্জাও কম হতো না। পেছনের ক্যারিয়ার তো সবারই ছিল। কিন্তু সামনের বাস্কেট, পেছনের চাকায় লক সিস্টেম, ফুল চেন-কভার বা ব্যাটারি চালিত হেড লাইট সবার পোষাত না। আর ছিল সিট-কভার ও বাহার রঙের হাতল-ঢাকনা। বেশ নরম নরম সিট-কভারের দামটা একটু বেশি তিরিশ-চল্লিশ, হাতল পনেরো। টিং টিং বেলের বদলে একসময় ব্যাটারি চালিত পিঁপিঁ হর্নও বাজারে বেরিয়েছিল। তবে আমার সাবেক বেলের আওয়াজটাই ছিল বেশি পছন্দের। মুচড়িয়ে মুচড়িয়ে তার সবচেয়ে সুন্দর শব্দটা বার করাটা ছিল একটা দারুণ ইঞ্জিনিয়ারিং গেম। আওয়াজ শুনেই বলতে পারতাম কোনটা পেতলের আর কোনটা স্টিলের বেল। বেলের আকারও ছিল নানা রকম -- সেই অনুযায়ী আওয়াজেরও রকমফের হতো। বাবারটা ছিল পেতলের -- বড়ো, মিহি টিংটিং নয় বেশ ভারি গলায় টেংটেং করত -- মেসোরটা আবার র‍্যালে, ওই স্টিলের টিংটিং -- দেখতেও তন্বী। দুপুরে বাবা যখন লাঞ্চের জন্য বাড়ি ফিরে স্ট্যান্ডের ওপর সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে ঘরে ঢুকতেন তখন আমার কাজ ছিল খুব জোরে জোরে হাত দিয়ে প্যাডেল ঘোরানো। তখনই শিখলাম -- চেন পড়ে গেলে কীভাবে আবার প্যাডেলের দাঁতে তাকে আটকে দিয়ে একবার ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে আরেকবার সোজাদিকে আগুপিছু করে পরাতে হয়, হঠাৎ পড়ে গিয়ে হ্যান্ডেলটা বেঁকে গেলে কীভাবে দুপায়ের মধ্যে সামনের চাকাটা চেপে রেখে দুহাত দিয়ে তাকে স্বস্থানে আনতে হয়, টাইরডের মাঝ বরাবর ইংরেজি 'H' অক্ষরে খোদাই করা স্টিলের পাতটারই বা কী মাহাত্ম্য। তখনও কিন্তু সাইকেল চড়া শিখিনি। 

    ক্লাস সিক্সে ওঠার আনন্দে (প্রতিভা দিদিমণির হাত থেকে বাঁচার আনন্দটাও এর মধ্যে লুকিয়ে ছিল কি না আজ মনে করতে পারছি না) অফিস ফেরত বিকেলে আব্দার করলাম আর বাবা আমাকে সিটে বসালেন। কিছুক্ষণ পেছনে ধরে ধরে তিনি ছেলেকে ঠেলে নিয়ে চললেন। এভাবে ফাঁকে ফাঁকে চলল কিছুদিন। সামনের, পাশের, অল্প দূরের মিঠু-পাপন-তপুরা ততদিনে হাফ-প্যাডেলে সাইকেল চালাতে শিখে গেছে। আমার আবার ওটা আসত না -- মারি তো গণ্ডার আর কি! কিন্তু প্যাডেল ঘোরাতে পারি না, ঘোরাতে গেলে আর প্যাডেলে পা পড়ে না। দু-একবার ধপাস হলাম। বাবা বললেন, 'আস্তে আস্তে শিখবি'। কিন্তু আমার তখন ট্রাই সাইকেল না পাওয়ার শোক মেটানোর তাড়া। তাই শতবার চেষ্টা করার বেদতুল্য বাক্যের ধারকাছ দিয়েও গেলাম না। পাড়ার রাস্তাটা ছিল ঢালের মতো -- বাবার অগোচরে ঠেলে ঠেলে সাইকেলটাকে নিয়ে যেতাম ঢালের ঠিক মাথায় চন্দকাকুদের বাড়ির কালভার্টের সামনে, হাতের ঠেকনায় কোনোক্রমে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ডান দিক দিয়ে উঠতাম কালভার্টের ওপরে -- এবার স্বচ্ছন্দে সিটে বসে প্যাডেলে চাপ দেওয়া যাচ্ছে -- ব্যাস, সামান্য একটু চাপ -- তারপর তো গড়গড়িয়ে সোজা মজুমদার কাকুদের পাশে খোলা জায়গাটায় নেমে যাওয়া যায়। ওই খোলা জায়গার প্রতিটি ইঞ্চি আমার চেনা, ফুটবল-ক্রিকেট-দাড়িবান্ধা (মানে খো-খো)-ডাংগুলি-দড়ি টানাটানি-সন্ধের ব্যাডমিন্টন বা নিছক আড্ডা -- সবই চলত সেখানে। তাই এবার বাঁ-দিক ঘেঁষে কোনো একটা উঁচু জায়গার পাশে ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে পড়া -- এভাবেই বেশ কয়েকবার চক্কর চলত সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসা ইস্তক। মাঝে মাঝে দুপুরে বাবা খেতে এলে তখনও দু-একবার এভাবে প্র্যাকটিস করে নিতাম। আর এভাবেই সাইকেল চড়ার প্রাথমিক পর্বটা শেষ হলো।

অথ সাইকেল কথা -- পাপড়ি মেলার পর্ব     

    একটা বড়ো কথা হলো, নতুন কিছু শিখতে হলে নিজের আগ্রহ চাই -- নাহলে আকর্ষণ তৈরি হয় না। আর আমার সাইকেল শেখার আগ্রহ এতটাই তীব্র ছিল যে খুব শিগগিরই বাবার সাইকেল ছেড়ে মেসোর সাইকেলের প্রতিও আকর্ষণ তৈরি হয়ে গেল। বাবার সাইকেলটা ফি-বিকেল পেতাম না, অফিস থেকে ফিরতে দেরি হতো -- কখনও ব্যাডমিন্টন প্র্যাকটিস সেরে রাতে বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু আমার তো পরাণ জ্বলিয়া যায় -- পাপন-তপু বা ওদিকের মানস-শোভন (আমরা ডাকতাম সুবোন) বা বাদল -- কেউই তাদের বাব-দাদাদের সাইকেল ছুঁতে দেবে না। অতএব গুটিগুটি পায়ে একদিন গেলাম মেসোদের রেল কোয়ার্টারে। মেসো চাকরি করতেন হর্টিকালচারে, অফিসের জিপগাড়ি এসে নিয়ে যেত। জঙ্গলে পরিবার নিয়ে থাকা যায় না, তাই একটা কোয়ার্টার ভাড়া নিয়ে ছিলেন। সাইকেলটা পড়েই থাকত, ছুটির দিন আর রবিবার ছাড়া তার বিশেষ ব্যবহারও ছিল না, তাই বেশ চকচকে -- অন্তত আমাদের হারকিউলিসের চেয়ে একটু তো দেখতে ভালোই। প্রথম একদিন মেসোকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'চালাতে দেবে?' মেসো একদম সাবধান করে দিয়ে বললেন, 'পা-টা ভাঙব। তোর মা আমারে বইক্কা সিধা কইরা দিব। কাম নাই।' ভাগ্যিস মাসি সামনে ছিলেন না, নইলে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন কোনোদিনই হতো না, আবার সেই তেন ত্যক্তেন করতে হতো।

    কথায় বলে অধ্যবসায়ের দাম আছে। তা সুযোগ একদিন মিলে গেল। তখন ক্লাস সেভেন -- বাবার দেখাদেখি আমিও ব্যাডমিন্টন খেলায় যোগ দিয়েছি -- রেলের খেলোয়াড় প্র্যাকটিস করান বিকেল চারটা থেকে। একদিন তিনটের সময় মাসির কাছে গেলাম -- নেই, কালিবাড়ি গেছেন দিদির সঙ্গে দেখা করতে। হলো না। দুদিন পরে আবার, -- না এবারেও পেলাম না -- 'মেসো বকবো। তুই যদি হাত-পা ভাঙ্গস। আমার ভয় করে। মেসোরে কইয়া নিস।' ব্যাস, হয়ে গেলো। আমি তো জানি মেসোর উত্তর কী হবে! এর কয়েকদিন পরে এমনিতেই গিয়েছি মাসির বাড়ি -- মাসি বললেন, 'আমারে বৃহস্পতিবারের পান আর কলা আইন্যা দিবি? তোর মেসোরে কইতে একদম ভুইল্যা গেলাম।' আমি তিনপায়ে খাড়া, মানে রাজি,--'তাইলে সাইকেলটা দাও, আমার নিউ কলোনি নোট আনতে যাইতে হইব। তার আগে আইন্যা দিই।' (আহা কি সুবোধ বালক!!) মাসি চাবিটা হাতে দিতেই মনে হলো স্বর্গ এরেই কয়। ততদিনে হারকিউলিসের সিটে বসে এক অদ্ভুত ইনোভেশনে প্যাডেল ঘোরানো শিখে গিয়েছি। উঠেই ডান পা দিয়ে বেশ জোরে প্যাডেলে চাপ দিতাম, সেটা ঘুরে বাঁ-পায়ের নাগাল পেতেই আবার বাঁ-পা দিয়ে জোর চাপ। ব্যাস সাইকেল চলতে শুরু করল, আর ঠেলাঠেলির প্রয়োজন নেই। অতএব মেসোর সাইকেল পেয়ে প্রায় প্রত্যেকটা পাড়ায় চক্কর মেরে মিনিট কুড়ি পরে পান-কলা এনে দিলাম। আমিও খুসি, মাসিও।

    ঠিক এর পরের শনিবার বিকেল পোনে চারটায় মাসির বাড়ি হানা দিলাম -- 'মাসি সাইকেলের চাবিটা দাও না। আমার প্র্যাকটিসের দেরি হইয়া যাইতাসে, বকা খাইতে লাগব।' কনফিডেন্ট মাসি শুধু একটা কথাই বললেন, 'মেসো সন্ধ্যার সময় আইব, তার আগেই আইস্যা পড়িস।' সন্ধে কেন, তার অনেক আগেই ফিরে এসে সাইকেল যথাস্থানে রেখে চুপি চুপি চলে এসেছিলাম। যা ভয় পেয়েছিলাম, এরপর আর কোনোদিন মেসোর সাইকেল নিইনি। 

    আসাম মেল, আমাদের জনপ্রিয় ট্রেন, আর ছিল কামরূপ এক্সপ্রেস। এছাড়া ছিল পাহাড় লাইনের ট্রেন। আজ মনে নেই, এর মধ্যে একটা আসত দুপুর বেলা, লেট করলে বিকেল হতো। সেদিন বোধহয় লেট করেই একটা ট্রেন ঢুকেছিল স্টেশনে। আমি তখন প্র্যাকটিস শেষ করে ফিরছি। সঙ্গে মেসোর সাইকেল। একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো ব্যাপার, একটু ভয়ও আছে -- যেন কিছু না হয়। তখনও তো পুরো এক্সপার্ট হয়ে উঠিনি। 

    তো ওভারব্রিজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত সাইকেলটাকে হাঁটিয়েই নিলাম। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এরপর রেলিঙে হেলান দিয়ে প্রথম শেখা কায়দায় সাইকেলে চড়লাম। কেননা নতুন জায়গা, সাইকেল নিয়ে প্রথম দিন প্র্যাকটিসে গেছি -- তায় মেসোর সাইকেল, বাড়িতেও জানে না। অতএব সাবধানের মার নেই ভেবে সদ্য অতীত কায়দায় সাইকেলারোহন করলাম এবং যথারীতি প্যাডেলে চাপ দিয়ে এগোলাম। রেলওয়ে স্কুলের দাদা-দিদিরা তখন স্কুল থেকে বেরোচ্ছে। আমার একটু 'গব্বো'ই হলো। এদিক ওদিক চোখ ঘোরাতে গিয়ে হ্যান্ডেল্টা বড্ড বেশি এবাঁক-ওবাঁক নিচ্ছে -- তখনও তো ব্যালেন্সএ সড়গড় হইনি! যাহোক, কোনক্রমে স্কুলের গেট পেরোলাম। এবার রাস্তাটা একটু ওপরের দিকে উঠেছে, রেল-নাগরিকের ভাষায় 'আপ'। এখানে প্যাডেলে একটু বেশি চাপ দিতে হয়, তার ওপর ক্রমাগত বেল দিতে হচ্ছে। নাহ আর টাল সামলানো গেল না। শুধু দেখলাম, সাদা প্যান্ট পড়া দুটো পায়ের ভেতর দিয়ে সাইকেলের সামনের চাকাটা ঢুকে গেল। রাস্তার ওপর ডানদিকে কাত হয়ে পড়ে গেলাম। পায়ে কেডস জুতো আর ফুল প্যান্ট ছিল বলে রক্ষে। চেনের কালিতে প্যান্টের দফারফা, কনুইয়ের কাছে ছড়ে গেছে, ডান হাতের চেটোয় মনে হচ্ছে জ্বলছে -- হ্যাঁ, ছড়ে গেছে। লম্বা ফর্সা ভদ্রলোকটি আমাকে উদ্ধার করলেন। তখন দেখলাম গার্ডবাবু, কাঁধে একটা কালো ব্যাগ-- ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি ফিরছিলেন বোধহয়। তখনই এই বিপত্তি। এক নবিস বালকের সাইকেলের গুঁতোয় তিনি আহত হলেও আমার করুণ মুখ দেখে বোধহয় দয়া হয়েছিল। নিজের পশ্চাদ্দেশের ব্যাথার চেয়েও সন্তানবৎ এই কিশোরের পতন বেদনাকে তিনি বেশি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই নিজে উঠলেন, আমাকে ওঠালেন, সাইকেলটা ওঠালেন, তারপর মৃদু হেসে বললেন, 'নতুন শিখছ বুঝি! যাও, আস্তে আস্তে সাবধানে যাও।' ভাগ্যিস কোথায় থাকি, বাবার নাম-ধাম কি -- এসব জিজ্ঞেস করেননি! আমিও বাড়ি ফিরে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ডেটল আর বোরোলিন লাগিয়ে দিলাম। শীত তখনও তেমন পড়েনি, তবু একটা ফুলহাতা টি-শার্ট সেদিন পরে রইলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, মেসোর সাইকেল আর না। আমার হারকিউলিসই ভালো।

অথ সাইকেল কথা -- পূর্ণ বিকশিত 

    এই ঘটনার তিন-চার বছর পর রেল শহর ছেড়ে এলাম সদাব্যস্ত মহকুমা শহরে। রেল-অঞ্চল বা কলোনি এখানেও আছে, তবে শহর থেকে দূরে -- সাইকেল আর রিক্সা সেখানকার প্রধান বাহন। আশির দশকে তখন সেখানে আজকের মতো চারচাকাদের এত দৌরাত্ম্য ছিল না -- শহর অঞ্চলেও রিক্সা আর সাইকেলে গিজগিজ করত -- বলা ভালো গলাগলি করে চলত। তবে চা-বাগানের জিপগাড়ি, বেশ কিছু স্বল্প দূরত্বের বা দূরপাল্লার বাস, মেডিক্যাল ভ্যান, পুলিশ ভ্যান, ট্রাক, ভেস্পা স্কুটার, মোপেড, কয়েকখান অ্যাম্বাসেডার ছাড়া আর কোনো ধরনের পেট্রোল বা ডিজেল চালিত গাড়ি সেখানে দেখা যেত না। অতএব নির্ভয়ে সাইকেল চালানো যেত। বরং বলা ভালো সেখানে সাইকেল চালানোটা ছিল একটা আর্ট বা বলা যায় অনেকটা অঙ্ক আর সায়েন্সও। কেননা সাইকেল চালকেরা এখানে চলে এঁকেবেঁকে -- কখনও দুটো রিক্সার মাঝখান দিয়ে, কখনও পথচারিদের পাশ কাটিয়ে হঠাৎ হঠাৎ গতি কমিয়ে বা বাড়িয়ে শরীর বেঁকিয়ে (এখন যেমন বাইকওয়ালারা চালায়)। ব্যাপারটা চোখ সওয়া হয়ে গেলে মনে মনে আমারও কনফিডেন্স বাড়ল এবং মামার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে শুরু করলাম প্রায়ই। শিখে গেলাম ভিড় রাস্তায় কীভাবে কখন প্রয়োজন অনুযায়ী ডান হাত বা বাঁ-হাত রিক্সার হুডের বাঁশ বা লোহার হাতল ধরে বিনা পরিশ্রমে এগোনো যায়, কখন এবং ঠিক কোন অ্যাঙ্গেলে দুটো রিক্সার মাঝ বরাবর রাস্তা করে নিতে হয়, পাশাপাশি আট ইঞ্চি দূরত্বে পঁচাত্তর ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দাঁড়ানো দুটো রিক্সার চাকার মাঝ বরাবর ক্রমে পনেরো থেকে পঞ্চাশ ডিগ্রিতে স্ট্যান্ডিং অবস্থায় সাইকেলের চাকা ঘুরিয়ে বেরোনোর জায়গা করে নেওয়া যায়। 

    কিন্তু মামার সাইকেলে হেডলাইট ছিল না। তাই অতটা এক্সপার্ট হয়েও এক সন্ধ্যায় টিউশন সেরে বাড়ি ফেরার পথে একটি প্রায় জনশূন্য কালভার্টের সামনে 'পথবন্ধ' মার্কা পাথরে ধাক্কা খেল এবং আমি খালের জলে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম কোনো রকম আঁচড় ছাড়াই। সাইকেলের বেলটা অবশ্য আর খুঁজে পাইনি, ক্যারিয়ারের একদিকের স্ক্রু খুলে যাওয়ায় সেটাও নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল আর টিউশনির  টাকাটা তখনও পাইনি। অতএব কাঁচুমাচু হয়ে মামাকে বৃত্তান্ত জানাতেই হয়েছিল। ফলে মাঝের ঘরে যখন আমি দিদা, মামীরা ও মামাতো ভাইবোনদের মাঝে আমি যখন একটি চিড়িয়াখানায় তখন পাশের ঘর থেকে মামার বজ্রনির্ঘোষ, 'আর কোনোদিন আমার সাইকেল ধরবি না।' এর একটাই অর্থ বাড়ির আর কোনো সাইকেলেই আমার স্পর্শ পড়বে না। অতএব তেন ত্যক্তেন।...     

অথ সাইকেল কথা -- বৃন্তচ্যূত 

    এবার আমার সাইকেলাকর্ষণের ইতি-কথা। এবারের পর্ব আর মহকুমা নয় একেবারে রাজধানী শহরে। গাড়িঘোড়ার প্রকোপ বেড়েছে কিন্তু লোকে সাইকেল চড়ে এখানে। অফিস-কাছারিতে রীতিমতো সাইকেল-স্ট্যান্ড আছে। বাবার হারকিউলিস এখনও হেরে যায়নি। বরং কালো রঙ আর মবিলে বেশ চকচকে হয়েছে। রিমের ওপরে সাইকেলের পেছন দিকের বনেটটা যদিও লজঝড়ে মার্কা হয়েছে। তবু চলে। নতুন করে ফ্রন্ট বাস্কেট আর লক লাগানো হয়েছে। বাজার-টাজার আনতে বেশ সুবিধে হয় -- বাবারও, আমারও। রাজপথের ধার ঘেঁষে চালিয়ে দিব্বি শহরের এ-মাথা থেকে অ-মাথা যাওয়া যায়। যাইও। 

    আমার প্রথম কর্মস্থলে প্রয়োজন না হলেও দ্বিতীয় কর্মস্থলে একটা সাইকেল 'নেসেসারি' হয়ে উঠলো (ইংরেজিতে বললে বক্তব্যের জোর বাড়ে বলেই শব্দটা ব্যবহার করতে হলো)। অথচ যা বেতন, তাতে সাইকেল কেনাটা পঞ্চবর্ষীয় পরিকল্পনার অধীন। হাত খরচ চালানোর জন্য বাবা মাসোহারা পাঠান। মাস চারেক পর হবু গৃহীনির টিউশনের চারশো টাকা আর আমার বেতনের আটশো টাকা দিয়ে অবশেষে হিরো এলেন। ঝাঁ-চকচকে। মনটাই হয়ে গেলো ফুরফুরে। মনে হতো পংখীরাজের পিঠে চড়ে চলেছি .....

    তৃতীয় তথা বর্তমান কর্মস্থলে বহুদিন সঙ্গী ছিল ওই হিরো। তাকে বাসের মাথায় চড়িয়ে নিয়ে এসেছিলাম দ্বিতীয় কর্মস্থল থেকে। বাসস্ট্যান্ড থেকে ওই সাইকেলে চড়েই মালপত্তর সহ বাড়ি ফিরি। তো কর্মস্থলে বেশ কয়েকজনের গাড়ি ছিল, আর ছিল বাইক বা স্কুটার। কয়েকজন অবশ্য পয়দল আসতেন। তার মধ্যে আমার এক সহকর্মীও ছিলেন। তিনি সাইকেল চালান, কথাটা বোধহয় সহকর্মীদের জানাতে চাইতেন না। তাই প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে রেললাইনের পাশে একটি সাইকেল সারাইয়ের দোকানে নিজের সাইকেলটি জমা দিয়ে আসতেন। ফেরার সময় ওইটুকু পথ হেঁটে গিয়ে তারপর সাইকেলে চেপে বাড়ি। আমি হিরোকে সঙ্গে করেই দিনাতিপাত করছিলাম। অবশেষে পাঁচ বছর পর যখন বেতন বাড়লো আর সহকর্মীরাও একে একে বাইক বা স্কুটার ভক্ত হয়ে উঠলেন তখন একদিন হিরোর সিটে হাত রেখে বললাম, 'বন্ধু, তোমায় বোধহয় এবার ছাড়তে হবে।'

    মা-বাবা বললেন, 'সাইকেলটা তাহলে কী করবি, কাউকে কম দামে বিক্রি করে দে।' আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম, 'মাথা খারাপ! অ্যাক্টিভা তো সবসময় চালানো যাবে না। প্রচুর তেলের দাম। মাসে একবার ফুল ট্যাঙ্কে যতদিন যায়, শুধু অফিস আসাযাওয়া। অন্যসময় সাইকেলটাই।' যেমন কথা তেমনি কাজ। প্রথম কয়েকমাস হিরো বাবা ও আমার সঙ্গে বাজারে যায়, কাছাকাছি এদিক-সেদিক যায়। তারপর থেকে সে শুধু বাবার সঙ্গেই যায়। বাবা একদিন আমার শিশুকন্যা সহ জলের মধ্যে পড়ে গেলেন। তারপর থেকে হিরোকে বাবাও খুব একটা সঙ্গী করতে চাইলেন না। তারপর একদিন ...... হিরো অভিমান করে চলে গেলো কলমিস্ত্রি দেবেনের সঙ্গে। 

    এতগুলো বছর পর আজ হঠাৎ করে হারকিউলিস, র‍্যালে আর হিরোদের কথা মনে পড়ছে। বোধহয় ওদেরকেই ফিরিয়ে আনতে হবে। জগতের নিয়ম তো চক্রবৎ ঘুরে চলা -- শেষ বিন্দু থেকে শুরুর বিন্দুর দিকে। তাই আকর্ষণটা এখনও একই রকম আছে, ত্যক্তেন আর করতে পারলাম কই ....শেষমেষ আরেকটি সাইকেল এলো -- তবে সে চলে কিন্তু চলে না। চাকা আছে, ঘোরে কিন্তু সাইকেল দৌড়য় না। সেটা ঘাম ঝরানোর জন্য, শরীর চর্চার জন্য। বেশ কিছুদিন চালানোর পর তারও কদর কমে গেল। জীবনে এলো জিম। আর সেই ব্যায়ামের সাইকেল বরাবরের জন্য অচল হয়ে পড়ে রইল...... 

********         

No comments:

Post a Comment

Note: only a member of this blog may post a comment.